Home » » বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫

বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫

বঙ্গভঙ্গ-১৯০৫
বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫

বঙ্গভঙ্গের পটভূমি:

মুঘল আমলের ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি' নামে একটি প্রশাসনিক ইউনিট গঠিত হয়েছিলো। ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় সংগঠিত দূর্ভিক্ষ ও যথাসময়ে সুষ্ঠ ত্রাণ না পৌঁছানোর কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি মত প্রকাশ করে যে, প্রদেশটির ভৌগোলিক বিশালতাই এই দূর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ। কেননা, তৎকালীন বঙ্গপ্রদেশের আয়তন ছিলো এক লক্ষ ঊননব্বই হাজার বর্গমাইল এবং লোক সংখ্যা ছিলো সমগ্র ভারতের লোক সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ফলে একজন প্রশাসকের পক্ষে এত বড়ো একটি প্রদেশে সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা সত্যই কঠিন ব্যাপার ছিলো। এছাড়াও কমিটি বাংলার প্রশাসনিক উন্নয়নে আরো কিছু সংস্কারের সুপারিশ করে। অবশ্য বাংলা বিভক্তির দাবি অনেক পুরোনো কারণ ইতিপূর্বে স্যার চালস্ গ্রান্ট ১৮৫৩ সালে বাংলা প্রদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করার কথা বলেছিলো। লর্ড ডালহৌসিও ১৮৫৪ সালে বাংলা বিভক্তির পক্ষে মত দেন। এছাড়াও ১৮৬৬ সালে ভারত সচিব লর্ড নর্থকোর্ট প্রশাসনিক দুর্বলতা দূর করে বাংলা প্রদেশের সীমানা রদবদলের কথা বলেন।

একথা ইতিহাস স্বীকার করে যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দান করেছে বাংলা ও বাঙালি জাতি। ১৮৯৮ সালে ভারতের বড়লাট হিসেবে আগমনের অল্পকালের মধ্যেই লর্ড কার্জন বুঝতে পারেন যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বাঙলি জাতির এক বিশাল ভূমিকা রয়েছে এবং তাদের উগ্র জাতীয়তাবদী চিন্তা-চেতনা এক সময়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জন্য বিপদজনক অবস্থায় পরিণত হতে পারে। সুতরাং বাংলা ও বাঙালি জাতিকে দুর্বল করতে ‘ভাগ কর শাসন কর নীতি' এর আবারো সফল প্রয়োগ ঘটাতে হবে। অবশ্য বাংলা বিভক্ত করার জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধা ছাড়াও লর্ড কার্জনের কাছে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক কারণও গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি ১৯০৪ সালে পূর্ববঙ্গ পরিদর্শন শেষে বুঝতে পারেন যে, ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলা অবহেলিত হয়ে আসছে। বিশাল বাংলা প্রেসিডেন্সির রাজধানী কোলকাতা হওয়ায় পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক বিকাশ, ব্যবসায় বাণিজ্য, যোগাযোগ ও শিক্ষার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেনি। তাঁর আশা ছিল বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন হতে পারে।


বঙ্গভঙ্গ ও নতুন প্রদেশ গঠন

লর্ড কার্জন তৎকালীন বাংলা প্রেসিডেন্সির পূর্বাঞ্চল ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম' নামে প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সচিবের নিকট প্রেরণ করেন। ভারত সচিব ব্রডারিক পরিকল্পনাটি অনুমোদন করে ১০ জুলাই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন এবং ১৬ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর হবে বলে ঘোষিত হয়। ঢাকাকে এই নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী এবং চট্টগ্রামকে বিকল্প রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসময় এই প্রদেশের আয়তন ছিলো ১ লক্ষ ৬ হাজার ৫ শত ৪ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ৩ কোটি ১০ লক্ষ ।


হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া:

বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ও এর বাস্তবায়ন শুরু থেকেই হিন্দুদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে ছিল। নতুন প্রদেশ বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা একজোট হয়ে কাজ করেন। এমনকি তারা নানা শ্রেণি পেশার মানুষকে বুঝাতে থাকেন যে, বঙ্গভঙ্গ কোলকাতার হিন্দুদের জন্য অভিশাপ বয়ে আনবে। তারা পত্রপত্রিকায়, সভা-সেমিনারে বক্তৃতায় একে বাঙালি বিরোধী, জাতীয়তাবাদী বিরোধী, বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করতে থাকেন। সুরেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ লাভ করতে থাকে। ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় বলা হয়, বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙালি জাতির সম্মুখে এরূপ বিপর্যয় আর কখনো আসেনি। ১৩ জুলাই ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘সঞ্জীবণী' পত্রিকার সম্পাদকীয় বাণীতে কৃষ্ণকুমার মিত্র লিখেছিলেন- ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ‘বয়কট’ যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে। মূলত, বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে জড়িত ছিল কোলকাতার হিন্দুদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা। আইন আদালতসহ নানাবিধ হিন্দু পেশাজীবী মানুষের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বাংলা । তাই হিন্দুরা এরকম একটা ফলবান বৃক্ষকে হাতছাড়া করতে চায়নি। এজন্যই তারা প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর না হওয়ার জন্য এবং পরবর্তীতে তা রদ করার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে ।


মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া:

বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যই বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল বলে মুসলমানরা একে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ছিল । ঢাকায় ছোটলাট হিসেবে আগমন করলে স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ লিখেছেন, এর মাধ্যমে নবগঠিত পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের বিরাট উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। জনগণ ক্রমশ বুঝতে পারছে যে, তাদের কল্যাণের জন্যই এই বিভক্তি। পূর্ববঙ্গ মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ায় তারা সরকারের নিকট থেকে বিশেষ বিবেচনা লাভ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও এখানকার দরিদ্র ও বেকার যুবকেরা উপযুক্ত চাকরি পেত না। কিন্তু নতুন প্রদেশে তারা চাকরি পাচ্ছে। সুতরাং পূর্ব-বঙ্গের মুসলমানদের সমর্থন যে, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে যাবে এটাই স্বাভাবিক।


বঙ্গভঙ্গ রদঃ

বঙ্গভঙ্গ কার্যকর না রাখার দাবিতে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া ছিল মুসলমানদের তুলনায় বেশি। তারা কলকাতার বর্ণ হিন্দুদের বুঝাতে সক্ষম হয় যে, এটা কার্যকর থাকলে তাদের বেশি ক্ষতি হবে। কারণ, নতুন প্রাদেশিক রাজধানীতে অবশ্যই শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে এবং সেখানে নতুন পূঁজিপতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হবে। ফলে কলকাতার ব্যবসায়ীদের একক কর্তৃত্ব খর্ব হবে ও মুনাফা কম হবে। আইনজীবীরা দেখলেন, ঢাকায় নতুন হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা হলে তাদের আইন ব্যবসায় ভাটা পড়বে কারণ তাদের বেশিরভাগ মক্কেলই ছিল ঢাকার জনগণ। এরকম ছোট বড় ক্ষতির কথা চিন্তা করে কলকাতার নানা শ্রেণি পেশার মানুষ গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আবার বঙ্গভঙ্গ এমন এক সময় কার্যকর হয় যার অনেক আগে থেকেই স্বদেশী আন্দোলন হয়েছিল । বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের ঘোষণা যেন সেই আন্দোলনে রসদ যোগাল। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে বিপ্লবীরা তাদের সর্বাত্মক এমনকি সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমও শুরু করল। ১৯০৮ সালে এরকমই আন্দোলনে যোগদান করায় প্রাণ দিতে হয় ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি প্রমূখকে। উল্লেখ্য যে, শুরুতে অনেক মুসলমান যুবকও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো। কিন্তু যখন হিন্দুরা তাদের দেবী কালীর নামে শপথ গ্রহণ করে এবং ‘বন্দে মাতরম' সঙ্গীত চালু করে তখন থেকে মুসলমানরা নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। তবে একথা ঠিক যে, ইংরেজরা বিশেষ করে লর্ড কার্জন বাংলা বিভক্তি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এমন কি নানারকম পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। ফলে হিন্দুদের আন্দোলন ক্রমশ দূর্বল হতে থাকে। কিন্তু ১৯১০ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ নতুন ভাইসরয় হিসেবে ভারতে এসে ঘোষণা দেন যে, আগামী বছর ব্রিটিশ সম্রাট ৫ম জর্জ ও সম্রাজ্ঞী মেরী ভারতে এসে দিল্লিতে দরবার করবেন এবং মীমাংসা করবেন। তাদের আগমন মসৃণ ও সাফল্যমণ্ডিত করতে লর্ড হার্ডিঞ্জ তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের সাথে আপোষ নীতি গ্রহণ করেন এবং মুসলমানদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে বঙ্গভঙ্গ রদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়।


বঙ্গভঙ্গ রদের ফলাফল ও গুরুত্বঃ

বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা যে হিন্দুদের উল্লসিত করবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা ছিল তাদের আন্দোলনের একমাত্র ও শেষ দাবি। কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার ব্রিটিশদের রাজনীতি জ্ঞানের ব্যাপক প্রশংসা করেন। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাম লিখেছেন, “১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়। আর বঙ্গভঙ্গ রদ করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দিয়েছে।” অন্যদিকে বঙ্গের মুসলমানরা এতে চরমভাবে ব্যথিত হয়। কারণ মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে উন্নতির যে লাল সূর্য আলো দান করতে শুরু করেছিল তা দুপুরের আগেই অস্ত যেতে বাধ্য হয়েছিল। কেননা, মাত্র পাঁচ বছরে মুসলমান ছাত্র সংখ্যা ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মওলানা মোহাম্মদ আলী বলেন যে, এ অঞ্চলের মুসলমানদেরকে তাদের রাজভক্তির প্রতিদানে তাদের অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। এরকম মন্তব্য ছিল প্রায় বাংলার প্রতিটি মুসলমানের। তবে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হয়েছিলেন বোধহয় নবাব সলিমুল্লাহ। এব্যাপারে তিনি এত আঘাত পেয়েছিলেন যে, তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। ক্ষোভে দুঃখে রাজনীতি থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। তবে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও মুসলমানদের উন্নতির চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারেননি। ১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে লর্ড হার্ডিঞ্জ বাংলায় এসে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও পদ্মা নদীর উপর একটি রেল ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। যাইহোক ক্ষুদ্র হলেও ব্রিটিশদের এ ক্ষতিপূরণ পূর্ববাংলার আকাঙ্ক্ষা কিছুটা হলেও পূরণ করেছিল। কেননা পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *