বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর তার ৬ যুগ পূর্ণ হয়েছে। দেশে দেশে বিদ্যমান সংঘাত, সংঘর্ষ এবং যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবতার নিরিখে জাতিসংঘ তার সেই সব উদ্দেশ্য পূরণে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। পরিমাপ করলে হয়তো ব্যর্থতার ভাগই বেশি হবে। জাতিসংঘ ব্যবহৃত হয়েছে বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। তাই যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করার জন্য ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও বিশ্ব থেকে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে জাতিসংঘের একেবারে নীর ভূমিকার কারণেই নানা দেশে বেড়েছে হিংসা, বৈষম্য, যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি এবং প্রাণহানি। রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও অনেক দেশ হারিয়েছে স্বাধীনতা, বরণ করেছে পরাধীনতা। ক্ষুদ্র এবং দুর্বল রাষ্ট্রসমূহ বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের পক্ষ থেকে আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। তাই বিশ্ব এখনো অশান্তি এবং অস্থিরতায় ভরা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, যুদ্ধ এবং সংঘাতে জর্জরিত বিশ্ব এখন অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন। নিরপেক্ষ এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারনে জাতিসংঘের প্রতি বিশ্ববাসীর সৃষ্টি হয়েছে আস্থাহীনতা। জাতিসংঘ মূলত আস্থা সংকটে ভূগছে। তাই এর সংস্কার ও সম্প্রসারণের দাবি উঠছে। জাতিসংঘের কাছ থেকে বিশ্ববাসী আরো বেশি দায়িত্বশীল এবং গঠনমূলক ভূমিকা আশা করে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ এবং নৈরাজ্য থেকে মুক্তির দেয়ার জন্য ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল লীগ অব নেশন। কিন্তু বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের অবাধ্যতা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় বিশ্বসংস্থা লীগ অব নেশন তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ক্রমান্বয়ে তা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই লীগ অব নেশন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ভেঙ্গে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যুদ্ধ-হানাহানি বন্ধ না হয়ে বরং আরো বেড়ে যায়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হবার পথ প্রশস্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অশান্তি দূর করার জন্য আবার ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী শক্তিবর্গ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন এবং ফ্রান্স এই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যেক্তা। প্রতিষ্ঠাকালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫১ আর বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল স্বাধীন দেশই এর সদস্য এবং এর সংখ্যা ১৯৩। এসব দেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়েছে, তাদের শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে পৃথিবীর মানুষকে রেহাই দেবার প্রত্যাশায়। কিন্তু বিশ্ববাসীর দুর্ভাগ্য, জাতিসংঘ বিশ্বে শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রসমূহ অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে জাতিসংঘের সদস্য হলেও শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকা মোটেই নিরপেক্ষ নয়। তাদের হাত থেকে ক্ষুদ্র জাতিসমূহের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে জাতিসংঘ সনদেই তার ব্যর্থতার বীজ নিহিত রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে ভেটো ক্ষমতা, যার মালিক হচ্ছে বৃহৎ পাঁচ রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন এবং ফ্রান্স। এরা সম্মিলিতভাবে কৌশলে এই ভেটো ক্ষমতা প্রবর্তন করেছে এবং এর মালিকানা নিজেরা নিয়ে নিয়েছে। মূলত এই ভেটো ক্ষমতা প্রবর্তনের ফলে সকল রাষ্ট্রের সমানাধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে।
জাতিসংঘ কখনোই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বরং তারাই জাতিসংঘকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই পাচঁটি রাষ্ট্রের মধ্যে যার ক্ষমতা এবং দাপট যত বেশি সে জাতিসংঘকে তত বেশি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং শক্তিশালী তাই যুক্তরাষ্ট্রই হয়ে গেছে এই জাতিসংঘের সার্বিক নিয়ন্ত্রক। যখনই জাতিসংঘে এই বৃহৎ পাচঁটি রাষ্ট্রের স্বাথের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এসেছে তখনই এরা নিজেদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেই প্রস্তাবকে বাতিল করে দিয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে আজ জাতিসংঘের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে এর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর কথা উঠেছে এবং ক্রমশ এই দাবি জোরালো হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হবার জন্য চেষ্টা করছে। ভারত, জাপান, জার্মানি, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হবার জন্য চেষ্টা করছে।
বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ এবং অশান্তি থেকে রক্ষা করাই ছিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। এ জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। জাতিসংঘে সনদের মূল কথা সকল রাষ্ট্রের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি, সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। কেউ অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ করবে না। কোন রাষ্ট্রের সাথে অপর কোন রাষ্ট্রের বিরোধ দেখা দিলে তা জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধান হবে এবং জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্তের বাইরে কোন রাষ্ট্র কাজ করবে না।
কাগজে-কলমে সবাই জাতিসংঘের মূল সনদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করলে ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে বৃহৎ শক্তিসমূহ বরাবরই পালন করেছে উল্টো ভূমিকা। নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এবং অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব বৃহৎ শক্তি সবসময় গায়ের জোরে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেছে এবং নিজেদের স্বার্থে সবসময় জাতিসংঘকে ব্যবহার করেছে। অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো জাতিসংঘের মূল সনদের নির্দেশনা হলেও জাতিসংঘকেই পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শক্তির জোরে দখল করেছে ইরাক- আফগানিস্তান, যে দুটি রাষ্ট্রই জাতিসংঘের সদস্য। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সম্পূর্ণ অসহায় এবং ব্যর্থ।
১৯৪৮ সালে কাশ্মীরের গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল জাতিসংঘে এবং গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন এই কাশ্মীর সংকট নিয়ে বছরের পর বছর ধরে লড়ে যাচ্ছে ভারত পাকিস্তান যার কোনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। এই ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইল তাদের সামরিক শক্তিবলে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছে নারকীয় নির্যাতন, বর্বরতা ও ভূমিদখলের তাণ্ডব। বিশ্বের নানা দেশের মধ্যস্থতা ও উদ্যোগে ফিলিস্তিনের উপর পরিচালিত ইসরাইলি হত্যা এবং নির্যাতন নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও জাতিসংঘ সরাসরি এ নিপীড়ন বন্ধ করতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। জাতিসংঘে এ পর্যন্ত যতবারই ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন প্রস্তাব এসেছে ততবারই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই প্রস্তাবকে বাতিল করে দিয়েছে।
বসনিয়ার দুই লক্ষাধিক বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির পেছনেও জাতিসংঘের ব্যর্থতা রয়েছে। এক্ষেত্রে ও জাতিসংঘ সার্বদের বর্বরতার হাত থেকে বসনিয়ার নিরপরাধ বেসামরিক মানুষগুলোকে রক্ষা করতে পারেনি। চেচনিয়া আর মিন্দানাওয়ের মানুষ দীর্ঘদিনের সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি কেবল জাতিসংঘের নীরব ভূমিকার কারণে। তবে পূর্বতিমুরের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে এই জাতিসংঘই। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সেখানে গণভোট অনুষ্ঠান করে তার রায় অনুযায়ী পূর্বতিমুরকে স্বাধীন করা হয়েছে। অন্যদিকে লিবিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধে ও জাতিসংঘ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধরা স্থানীয় আদিবাসী রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিধন চালালেও জাতিসংঘ তা বন্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। এ ধরণের নানা কারণে সম্প্রতি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা ও সক্ষমতা বারংবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions