জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি
আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থার ইতিহাস রাষ্ট্র কর্তৃক প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে উঠে বিশেষ কিছু বিষয়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে। সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান, যুদ্ধ প্রতিরোধ এবং যুদ্ধনীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৮৯৯ সালে হেগে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হেগ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে যে কনভেনশন প্রণীত হয় তার উপর ভিত্তি করে স্থায়ী সালিশী আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯০২ সাল থেকে কাজ শুরু করে। ১৯০৭ সালে যে হেগ সম্মেলন হয়, সেখানে ২৬ টি ইউরোপীয় রাষ্ট্র অংশগ্রহণ করে এবং এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠনের আকাঙ্খা রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে অনুভূত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হলে বিশ্বসংগঠন গঠনের ধারণাটি আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার লক্ষ্যে বিশ্ব সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। ১৯১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি প্যারিস সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন তাঁর চৌদ্দ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন, যেখানে মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, যৌথ নিরাপত্তা, সাধারন নিরস্ত্রীকরণের বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয় এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় শান্তি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিশ্ব সংগঠন গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ পায় ।
জাতিসংঘের পূর্বে লীগ অব নেশন্স নামের আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে শান্তি এবং সহযোগিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দায়বদ্ধ ছিল। ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শান্তি এবং নিরাপত্তা' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লীগ অব নেশন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। লীগ অব নেশন্স ৫৮ টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত হয়েছিল। শুরুতে লীগ অব নেশন্সের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত হলেও ১৯৩০ সালের পর থেকে জার্মানী, ইতালি এবং জাপানের মতো অক্ষশক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হলে লীগ অব নেশন্সের কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, লীগ অব নেশন্স বিশ্বের শান্তি রক্ষার প্রধান লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘ ঘোষণা লীগ অব নেশন্স ব্যর্থ হলেও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতারা লীগ অব নেশন্সের ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন। ‘জাতিসংঘ' নামের প্রথম সূচনা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের দ্বারা এবং এর প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সম্পাদিত ‘সম্মিলিত জাতিসমূহের ঘোষণার' মাধ্যমে, যেখানে ২৬টি দেশের প্রতিনিধিবর্গ প্রথমবারের মতো অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে যুদ্ধে করার ঘোষণা দেয়। ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন সানফ্রানসিস্কোতে আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রশ্নে ‘জাতিসমূহের সম্মেলনে’ ৫০ টি দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘ সনদ রচনা করেন। ১৯৪৪ সালের আগষ্ট-অক্টোবরে ওয়াশিংটনের ডাম্বার্টন ওকসের বৈঠকে চীন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গের প্রস্তাবগুলির ওপর ভিত্তি করে এই সনদ গড়ে ওঠে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ৫০টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন সনদটি অনুমোদন ও স্বাক্ষর করেন। পোল্যান্ড সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও পরে এতে স্বাক্ষর প্রদান করে প্রথম স্বাক্ষরকারী ৫১টি রাষ্ট্রের একটিতে পরিণত হয়। ১৯৪৫ সালের ২৫ অক্টোবর চীন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও স্বাক্ষরকারী অন্যান্য অধিকাংশ দেশের সনদ অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাতিসংঘ সংগঠন বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা ১৯২ এবং জাতিসংঘের কর্মপরিধি বিশ্বব্যাপি বিস্তৃত। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সনদে উল্লেখিত সমুদয় দায়দায়িত্ব যারা গ্রহণ করবে এবং সংগঠনটির বিচারে যারা এসব দায়দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম ও ইচ্ছুক সেরূপ অন্য সকল শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকবে (সনদের অনুচ্ছেদ নং ৪)। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচার নীতির উপর ভিত্তি করে শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সকল মানুষের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। আন্তর্জাতিক সংকট মুহূর্তে এই সংগঠন জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি করে ভারসাম্য বজায় রাখে। শান্তিরক্ষা, শান্তি সৃষ্টি, সংকট প্রতিরোধ এবং মানবীয় সাহায্যের জন্য জাতিসংঘ বেশী পরিচিত হলেও এই দিকগুলোর বাইরেও বিভিন্ন উপায়ে জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গসংস্থাসমূহ (বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা, ফান্ড এবং কর্মসূচি) বিশ্বকে প্রভাবিত করে। এই সংগঠন বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন মৌলিক ইস্যু, যেমন টেকসই উন্নয়নের ধারণা থেকে শুরু করে পরিবেশ এবং শরণার্থীদের রক্ষণ, দুর্যোগ সহায়তা, সন্ত্রাসবাদ দমন, নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার, শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, ভূমি মাইন অপসারণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য পূরণে কাজ করে থাকে ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions