জার্মানির পরাজয়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় : লুফটওয়াফ তথা জার্মান বিমান বাহিনী প্রধান মার্শাল গোয়েরিংয়ের চিঠি থেকেই বোঝা যায় জার্মানির ভাগ্য ইতোমধ্যে নির্ধারিত। কিন্তু তাতে দমবার পাত্র ছিলেন না হিটলার। তিনি এ টেলিগ্রামের জবাবে মার্শাল গোয়েরিংকে বরং গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গোয়েরিং ২৫ এপ্রিল ভোরে গ্রেফতার হলে সেদিন একটি বোমা নিক্ষিপ্ত হয় জার্মান চ্যান্সেলর হাউসে এসে। জেনারেল রিটার ফন গ্রেইম ও নারী টেস্ট পাইলট হানা রিচ গিয়ে দেখা করেন হিটলারের সাথে। হিটলার গোয়েরিংয়ের পদাধিষ্ঠিত করেন আহত ফন গ্রেইমকে যিনি পরপর তিন দিন বাংকারে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হন। এর মধ্যেই এসএসের কমান্ডার হেইনরিখ হিমলার একই সাথে মিত্রবাহিনীর সাথে আলোচনা এবং পশ্চিমে জেনারেল আইসেন হাওয়ারের কাছে জার্মান বাহিনী আত্মসমপর্ণের প্রস্তাব দেন। হিটলার হিমলারের প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারমেন ফেজেলিয়ানকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করেন ।
হিটলার নিশ্চিত পরাজয় জেনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আর যাই হোক তিনি মিত্রবাহিনীর কাছে অন্তত আত্মসমর্পণ করবেন না। এক্ষেত্রে আত্মহননই হয় তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা এবং এক গৌরমময় পরিণতি। আর তাই হিটলারকে না পেয়ে মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানির আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন জেনারেল আলফ্রেড জোডল। প্রথমে ৪ মে ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারি হল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিম জার্মানি ডেনমার্কে অবস্থানরত জার্মান সৈন্যদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৪৫ সালের ৭ মে জেনারেল বোহনি নরওয়েতে সৈন্যদের আত্মসমর্পণের কথা বলেন। এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে জেনারেল ফার্ডিনান্দ শোরনারের নেতৃত্বাধীন জার্মান সৈন্য আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি। হিটলার ৩০ এপ্রিল তাকে জার্মান বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ পদে ভূষিত করেছিলেন। তারপরেও ১৯৪৫ সালের ৮ মে সব রণাঙ্গন থেকে থমকে যেতে হয়ে জার্মান বাহিনীকে। এসময় আত্মসমর্পণ না করে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত শোরনার অস্ট্রিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে জার্মান নেতা হিটলার বার্লিনেই ছিলেন। সেখান থেকে তার পালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তিনি নিজেই বলেছে অন্তত যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার মত কাপুরুষ অ্যাডলফ হিটলার হয়; তার কাছে যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সর্বজনীন এবং যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের মহান লড়াই। তিনি ভেবেছিলেন কোনোভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পদানত করা গেলে পুরো বিশ্বই অন্তত একবার জার্মানির সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে। তবে প্রাকৃতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে রুশরা জয়লাভ করে যুদ্ধ, জীবনের শেষ দেখতে পান অ্যাডলফ হিটলার। পূর্ব প্রুশিয়ার রাসটেনবুর্গ থেকে একটি ব্যর্থ আক্রমণে কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যান হিটলার। এরপর তিনি অবস্থান নেন বার্লিনের এক ভূগর্ভস্থ বাংকারে । ১৬ জানুয়ারি বাংকারে প্রবেশ থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত একটি বারের জন্যও বাইরে আসার সুযোগ হয়নি হিটলারের। অনেক শক্তিশালী বোমার আঘাতে বাংকারটির কোনো ক্ষতি হয়নি বললেই চলে। পাশাপাশি সেখানে পর্যাপ্ত রসদের যোগানও ছিল। রুশ সৈন্যরা চারদিক থেকে বাংকারটা ঘিরে ফেলছে জানতে পেরে ২২-২৩ এপ্রিল শীর্ষস্থানীয় জার্মান অফিসাররা সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে হিটলার সেখানে অবিচল থেকে যান সেই বাংকারে। এই বাংকারেই বিয়ে করার পর ৩০ এপ্রিল স্ত্রী ইভা ব্রাউনসহ আত্মহত্যা করেন হিটলার। ফুয়েরার বাংকার নামে পরিচিত এ স্থান মাটির প্রায় ৫৫ ফুট নিচে অবস্থিত। প্রায় ৪ মিটার কংক্রিকেটের আস্তরণযুক্ত এ স্থান প্রায় ৩ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে অবস্থিত। জাপানের আত্মসমর্পণকে মনে করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ের ঘটনা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কুখ্যাত ভার্সাই চুক্তি যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ করে দেয় তেমনি বিচারের নামে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল ছিল আরেকটি প্রহসনের নামান্তর। বিজয়ী শক্তি সুযোগ পেলে সবদিক থেকে পরাজিত শক্তির ওপর চড়াও হয় এ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে যে ব্রিটিশরা জার্মানদের বিচারের সম্মুখীন করতে থাকে তারাই ভারতবর্ষ ও আফ্রিকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে গেলে এক জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপ করে মিত্রবাহিনীর তরফে যুক্তরাষ্ট্র যে অপরাধ করেছিল তার বিচার করে সাধ্য কার। সেদিক থেকে ধরতে গেলে নাজি জাতীয়তাবাদী যোদ্ধাদের বিচার প্রহসন বৈ কিছুই নয়। এক্ষেত্রে অনেক ইতিহাসবিদ সরাসরি বলেই দিয়েছেন এক্ষেত্রে জার্মানি পরাজিত হয়েছে বলে বিচার হয়েছে তাদের, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের নামে হত্যা করা হয়েছে অগণিত কুশলী জার্মান সেনা নায়ককে। এদিকে মিত্রবাহিনী যদি পরাজিত হত তবে লন্ডন কিংবা মস্কোর রাস্তায় তেমনি তাদের অনেক বীর সেনানীর লাশ বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ঝুললে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions