জাতিসংঘ কাকে বলে?
স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রধান সংগঠন হিসেবে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। যুদ্ধের অভিশাপ থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪১ সালের আটলান্টিক সনদে ‘জাতিসংঘ' নামটি সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক বিরোধ সমাধান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে একটি সাধারণ যুদ্ধ বিরতির আহবান জানায়। এর প্রেক্ষাপটে উড্রো উইলসন তাঁর বিখ্যাত চৌদ্দ দফা পেশ করেন। উইলসন তাঁর চৌদ্দ দফা শর্তের ১৪ নং দফায় বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ জুন, ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত ‘ভার্সাই চুক্তি'র মাধ্যমে লিগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জের জন্ম হয়। ১০ জানুয়ারি, ১৯২০ সালে সংস্থাটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। জাতিপুঞ্জের ৩টি অঙ্গসংস্থা ছিল- পরিষদ, কাউন্সিল এবং সচিবালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০ এপ্রিল, ১৯৪৬ সালে সংস্থাটি বিলুপ্ত হয়। সংস্থাটির উত্তরসূরি হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের জন্ম হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৯১৯ সালে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়েছিল, তার ব্যর্থতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বিশ্বের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৪১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আটলান্টিক মহাসাগরে ব্রিটিশ রণতরী প্রিন্সেস অব অয়েলস-এ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মিলিত হন। ১২ আগস্ট, ১৯৪১ সালে তাঁরা একটি শান্তি পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করেন। এটি বিখ্যাত ‘আটলান্টিক সনদ' নামে খ্যাত। আটলান্টিক সনদে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের পক্ষে স্বাক্ষর করেন রুজভেল্ট ও চার্চিল। ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা মস্কোতে মিলিত হন এবং যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি বজায় রাখার জন্য জাতিসমূহের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌছান। এই চুক্তি ‘মস্কো ঘোষণা' নামে পরিচিত।
১৯৪৪ সালে ওয়াশিংটন ডিসির ডাম্বারটন ওকস এ অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের জন্য প্রথম সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য রুজভেল্ট, চার্চিল এবং স্ট্যালিন ১৯৪৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের ইয়াল্টায় এক সম্মেলনে মিলিত হয়। এই সম্মেলন 'ক্রিমিয়া সম্মেলন' নামেও পরিচিত। এই সম্মেলনের ভিত্তিতে ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন বিশ্বের ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে ১১১ ধারা সম্বলিত জাতিসংঘের মূলসনদে স্বাক্ষর করেন। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হয়। এ জন্য প্রতি বছর ২৪ অক্টোবর ‘জাতিসংঘ দিবস' হিসেবে পালিত হয়। জাতিসংঘের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৯৩। এ সংস্থার সদর দপ্তর নিউইয়র্ক। ইউরোপীয় দপ্তর জেনেভা। দাপ্তরিক ভাষা ৬টি। এগুলো হচ্ছে ইংরেজি, চীনা, স্প্যানিশ, ফরাসি, রুশ ও আরবি। জাতিসংঘের পতাকায় আছে হালকা নীলের উপর সাদা রঙের জাতিসংঘের প্রতীক। জাতিসংঘের প্রতীকের মাঝখানে পৃথিবীর মানচিত্র। দুই পাশে দুইটি জলপাই গাছের শাখা। জলপাই গাছ শান্তির প্রতীক।
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর অভিভাবক হিসেবে জাতিসংঘকে বিবেচনা করা হয়। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions