ময়নামতি কোথায় অবস্থিত
উত্তর: ময়নামতি কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত।
ময়নামতির অবস্থান:
কুমিল্লার ময়নামতি বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম ও প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কুমিল্লা জেলা শহরের সাত কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ি এলাকায় বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি অবস্থিত। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে ময়নামতির শালবন বিহার ধ্বংসাবশেষ। সমগ্র প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাটি ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ি অঞ্চলের প্রায় ১১ মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত। শালবন বিহারের সন্নিকটে স্থাপিত যাদুঘরে ময়নামতিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ময়নামতির উৎপত্তি ও নামকরণ:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজের সময় ময়নামতিতে ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে খনন ও নির্মাণকাজের ফলে এখানকার নিদর্শনগুলো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ময়নামতিতে বৌদ্ধধমকে কেন্দ্র করে এক উন্নত সভ্যতার বিকাশলাভ ঘটে। ১৯৫৫-৫৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখানে জরিপ কাজের মাধ্যমে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ৫৪টি স্থান সংরক্ষণ করার জন্য চিহ্নিত করে। চিহ্নিত স্থানগুলোর কয়েকটিতে খননকার্য চালিয়ে ময়নামতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার অনেক নিদর্শন উদ্ধার করে ।
অষ্টম শতাব্দীতে রাজা বুদ্ধদেব ময়নামতি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন বলে ধারণা করা হয়। ৯ম ও ১০ম শতকে এ অঞ্চলে চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের আধিপত্য ছিল। চন্দ্রবংশীয় রাজাদের মধ্যে প্রখ্যাত ছিলেন রাজা মানিক চন্দ্র। মানিক চন্দ্রের মৃত্যুর পর রাণী ময়নামতি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে রাজকার্য পরিচালনা করেন। রাণী ময়নামতির নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ হয় ময়নামতি।
ময়নামতির প্রধান প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন:
ময়নামতিতে আবিষ্কৃত প্রধান প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
ক. শালবন বিহার:
অধিকসংখ্যক শালবৃক্ষের কারণে এই স্থাপনার নাম ‘শালবন বিহার' বলে মনে করা হয়। এখানে চতুষ্কোণ আকৃতির একটি বিরাট বৌদ্ধবিহার পাওয়া গেছে। ইট-নির্মিত বিহারের প্রতিটি দেওয়াল প্রায় ১৬৮ মিটার লম্বা। মূল বিহারটি ১৬ ফুট প্রশস্ত ও ৪-৬ ফুট উঁচু দেওয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। উত্তর দিকে ইট নির্মিত ৫৩ ফুট দীর্ঘ রাস্তা রয়েছে। এটিই একমাত্র প্রবেশপথ। সাড়ে বাইশ মিটার প্রশস্ত তোরণ দিয়ে ৩৩ বাই ২৪ ফুট হলঘরে প্রবেশ করা যায়। বিহারের চতুর্দিকে ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ১২ বাই ১২ ফুট ১১৫ টি কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষ দেয়াল দিয়ে একটি থেকে আরেকটিকে পৃথক করা হয়েছে। কক্ষগুলোতে বুদ্ধমূর্তি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী রাখার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল ।
খ. কোটিলা মুড়া:
শালবন বিহার হতে ৫ কিলোমিটার উত্তরে সেনানিবাস অঞ্চলে কোটিলা মুড়া অবস্থিত। একটি টিলার উপর তিনটি স্তূপের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ তিনটি স্তুপকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান তিনটি প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এগুলো হচ্ছে ক) বুদ্ধ (জ্ঞান), খ) ধর্ম (ন্যায়) এবং গ) সংঘ (শৃঙ্খলা)।
গ. চারপত্র মুড়া:
কোটিলা মুড়া থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সেনানিবাসের মধ্যেই একটি ছোট পাহাড়ের উপরে চারপত্র মুড়ার অবস্থান। এটি মূলত একটি সমাধিক্ষেত্র। সমাধিস্থলের পূর্বদিকে একটি হলঘর আবিষ্কৃত হয়েছে। চারপত্র মুড়ার প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে ১০৫ ফুট দীর্ঘ ও ৫৫ ফুট প্রস্থ একটি বৌদ্ধমন্দির পাওয়া গেছে।
ঘ. রাণি ময়নামতির প্রাসাদ:
ময়নামতি-লালমাই পাহাড়শ্রেণির উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত এবং সংলগ্ন ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু স্থানে রাণি ময়নামতির প্রাসেেদর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি খননের ফলে বড় আকারের প্রাচীর আবিষ্কৃত হয়েছে।
ঙ. আনন্দ বিহার :
এ অঞ্চলে প্রাপ্ত বৌদ্ধ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আনন্দ বিহার সবচেয়ে বড়। এই বিহারকে আনন্দ রাজার বাড়ি বলে মনে করা হয় । কোটিলা মুড়া থেকে এক কিলোমটিার দক্ষিণে ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ের উপত্যকায় সমতল ভূমিতে আনন্দ বিহার অবস্থিত। জানা যায়, অষ্টম শতকের দেববংশের রাজা আনন্দ দেব শালবন বিহারের অনুরূপ একটি বিশাল বৌদ্ধবিহার স্থাপন করে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে অবদান রেখেছিলেন। আনন্দ বিহারের কয়েকটি দেওয়াল পোড়ামাটির ফলক- চিত্র রয়েছে। সাপ-নেউল, মাছ, শূকর, ময়ূর, রাজহাঁস, ঘোড়া, বানর, যোদ্ধা, সিংহ প্রভৃতির দৃষ্টিনন্দন চিত্র রয়েছে।
চ) ময়নামতিতে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী:
ময়নামতিতে উদ্ধারকৃত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে ০৮টি তাম্র ফলক, ০৩টি স্বর্ণমুদ্রা, ২২৪টি রৌপ্যমুদ্রা, ০৬টি স্বর্ণালঙ্কার, ০২টি ব্রোঞ্জের স্মারকাধার, ব্রোঞ্জনির্মিত অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ত্ব ও অন্যান্য বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি; অসংখ্য পোড়ামাটির ফলকচিত্র, অলংকৃত ইট, প্রস্তর-ভাস্কর্য, তামারপাত্র, বিভিন্ন ধাতুনির্মিত আংটি, কানের দুল ও হাতের চুড়ি; রৌপ্যখন্ড, লোহার পেরেক, কড়া, বঁড়শি, নানা প্রকার খননযন্ত্র, দা, ছুরি, কাঁচি, শিলনোড়া, পোড়ামাটির অসংখ্য তৈজসপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, ইত্যাদি ।
ময়নামতির সভ্যতা ধ্বংসের প্রকৃত কারণ আজও জানা যায়নি। এখানে কোনরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনর্জাগরণের সময় এ বৌদ্ধসভ্যতাটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং কালক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
ময়নামতিতে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর গুরুত্ব:
ময়নামতির সমাজ-ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ময়নামতির শালবন বিহারে খননের ফলে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসন থেকে দেববংশ নামে এক নতুন বৌদ্ধ রাজবংশ ও তাঁদের বংশানুক্রম পাওয়া যায়। চারপত্র মুড়ায় আবিষ্কৃত তাম্রশাসনগুলো চন্দ্র রাজাদের বংশানুক্রম, বিভিন্ন অভিযান ও তাঁদের সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিচয় তুলে ধরে। এছাড়া এই তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, শ্রীচন্দ্র থেকে গোবিন্দচন্দ্রের শাসনকাল পর্যন্ত ঢাকার বিক্রমপুরে চন্দ্র রাজাদের রাজধানী ছিল। লালমাই-ময়নামতিতে প্রাপ্ত ২২৭টি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রমাণ করে যে, এখানে মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন ছিল। এখানে আবিষ্কৃত আব্বাসীয় খলিফাদের মুদ্রা মধ্যপ্রাচ্যের সাথে তৎকালীন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের সাক্ষ্য দেয়। এখানে প্রাপ্ত বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তিসমূহ বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণযুগের পরিচয় বহন করে। শালবন বিহারের ক্রুশাকার মন্দিরের ভিত্তিভূমি অলংকৃত পোড়ামাটির ফলকচিত্রগুলো তৎকালীন বাংলার লোকায়ত শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ময়নামতিতে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী তৎকালীন সমাজের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ময়নামতি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার খ্রিস্টীয় ৭ম-১২শ শতাব্দীর শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ঐতিহাসিক দলিল ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions