চাকমা কারা
বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা। চাকমা জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘চাঙমা’-নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। চাকমাদের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মতামত প্রচলিত আছে। একটি মতামত অনুযায়ী, চাকমারা চম্পক নগরের অধিবাসী ছিলো। চাকমা লোককাহিনীতে বলা হয়, এক চাকমা রাজপুত দেশজয়ের উদ্দেশ্যে চম্পকনগর থেকে মায়ানমারের আরাকানে গমন করেন এবং নবম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানের বেশকিছু অঞ্চল চাকমারা শাসন করেন। পরে স্থানীয় আরাকানীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম জেলায় এবং পরে আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তারা বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমনের পর চাকমারা তুলা চাষের মাধ্যমে প্রথমে মুঘল-সরকার ও পরে বৃটিশ-সরকারের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। বৃটিশ আমলেই চাকমাসহ পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীসমূহ পুরোপুরি কেন্দ্রীয় বৃটিশ সরকারের শাসনাধীনে আসে এবং বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার তাদের জন্য ১৯০০ সালে হিলট্রাকট্স ম্যানুয়েল প্রণয়ন করে। এই ম্যানুয়েল অনুসারে পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীসমূহের জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ম্যানুয়াল পরবর্তীতে সংশোধিত হয়।
আবাস ও ভাষা: চাকমারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় বসবাস করে । সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চাকমা বসবাস করে রাঙামাটি জেলায়। এরপর খাগড়াছড়ির স্থান। বান্দরবান ছাড়াও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাও অল্পসংখ্যক চাকমা বসবাস করে। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যে বেশকিছু চাকমা বাস করে। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা সর্ববৃহৎ। চাকমাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লক্ষ (২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী ৪,৪৪,৭৪৮ জন)। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, চাকমারা পূর্বে টিবেটো বার্মা ভাষা পরিবারভুক্ত আরাকানি ভাষায় কথা বলত। চাকমাদের লিপিতে আরাকানি অক্ষরের প্রাধান্যই বেশি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে তারা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় কথা বলে। চাকমা ভাষার নিজস্ব লিখিত লিপি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে চাকমা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে। এছাড়াও সংগীত ও চলচিত্রেও চাকমা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। নরগোষ্ঠীগত প্রভাব: চাকমাদের মধ্যে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তারা উচ্চতায় মাঝারি থেকে বেঁটে। তবে কারো কারো উচ্চতা লম্বাকৃতির। দৈহিক গড়নে বেশ শক্তিশালী। সুঠামদেহের অধিকারী চাকমা নৃগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্য অঞ্চলে চলাচলে অভিজ্ঞ।
বিবাহ ও পরিবার: চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক ও পিতৃসূত্রীয়। ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব পিতা, স্বামী বা অন্য কোনো বয়স্ক পুরুষের হাতে ন্যস্ত থাকে। সম্পত্তি ও বংশমর্যাদার উত্তরাধিকার পিতা থেকে পুত্রের ওপর বর্তায়। যৌথ পরিবার এবং বিস্তৃত পরিবার ব্যবস্থা তেমন পরিলক্ষিত হয় না। পুত্রসন্তানেরা আত্মনির্ভরশীল হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে আলাদা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়। সাধারণত চাকমাদের মধ্যে নিজ বংশে সাত পুরুষের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ । চাকমা সমাজে অন্তর্বিবাহ ও বহির্বিবাহের প্রচলন রয়েছে। চাকমা যুবকরা সাধারণত নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে করে থাকে। তবে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো নিষেধ নেই। এ সমাজে বর কনের বাড়িতে যায় না। বর পক্ষের লোকজন গিয়ে কনেকে তুলে নিয়ে এসে বরের বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠান করে । বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা চাকমা সমাজে বিরল।
রাজনৈতিক সংগঠন: পরিবরি চাকমা সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠন। এর পরের স্তরগুলি হচ্ছে পর্যায়ক্রমে গোত্তি বা গোজা, আদাম বা পাড়া, গ্রাম বা মৌজা এবং চাকমা সার্কেল। কতগুলো চাকমা পরিবার নিয়ে গঠিত হয় আদাম বা পাড়া। আদামের প্রধানকে বলা হয় কারবারী। চাকমা রাজা গ্রাম বা মৌজা প্রধানের সাথে আলাপ করে কারবারীকে নিয়োগ করেন। কারবারীদের কাজ হল গ্রামের শান্তি-শ -শৃঙ্খলা রক্ষা ও সালিশ বিচারকাজে মৌজাপ্রধানকে সহায়তা করা। কারবারীকে কোনো বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় না। কতগুলো আদাম মিলে গঠিত হয় চাকমা গ্রাম বা মৌজা। মৌজার প্রধান হেডম্যান। চাকমা রাজার সুপারিশক্রমে স্থানীয় জেলা প্রশাসক হেডম্যান নিয়োগ করেন। হেডম্যানদের প্রধান কাজ সংশ্লিষ্ট মৌজার খাজনা আদায় করা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সালিশের মাধ্যমে গোলোযোগ নিস্পত্তি করা। চাকমা সমাজের কয়েকশত মৌজা বা গ্রাম নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত হয়। চাকমা রাজা চাকমা সার্কেলের প্রধান। চাকমা রাজা বংশপরম্পরায় নিযুক্ত হন। চাকমা সমাজের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তিনি জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করেন। চাকমা রাজা চাকমা সমাজের সংহতির প্রতীক ।
চাকমা অর্থনীতি: জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকমারা পাহাড়ের ঢালে জুমচাষ করে। এ পদ্ধতিতে পাহাড়ের জঙ্গল, গাছপালা কেটে শুকানোর জন্য একমাসের মতো রেখে দেয়। এপ্রিল মাসের প্রথম তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। জুম পরিষ্কার করে বৃষ্টি হওয়ার পর ধান, তুলা, শসা, তিল, ভূট্টা ইত্যাদি বীজ একটা বাড়িতে নিয়ে একত্রিত করে দা/কাস্তে/নিড়ানির সাহায্যে ছোট ছোট গর্ত করে তাতে বপন করা হয়। পরবর্তীতে যে ফসল যখন পাকে তখন তা ঘরে তোলা হয়। এই চাষপদ্ধতিতে চাষাবাদই হচ্ছে জুমচাষ। চাকমা সমাজে সমাজে উদ্যানকৃষির প্রসার ঘটেছে এবং উদ্যানকৃষির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। চাকমারা বাঙালিদের কাছ থেকে হালচাষ পদ্ধতি শিখছে। দুই পাহাড়ের মাঝখানে চাকমারা ধান চাষ করে । কৃষি ছাড়াও তারা হাঁস-মুরগি ও শূকর পালন করে থাকে ।
চাকমাদের খাদ্য, পোশাক: চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। তা ছাড়া মাছ, মাংস, ফলমুল, ডাল ইত্যাদি তারা খেয়ে থাকে । স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত মদ চাকমাদের অন্যতম সামাজিক পানীয়। চাকমা পুরুষেরা ধুতি ও ঘরে-বোনা কোট পরিধান করে। মাঝে মাঝে পাগড়া (খাবাং) পরে। মেয়েরা ‘পিনধান’, ‘খাদি' ও কখনও কখনও খাবাং এবং শাড়ি-ব্লাউজও পরে থাকে। ‘পিনধান’ হল ঘরে বোনা কালো রঙের স্কার্ট বা ঘাগরা যার উপরে ও নিচে লাল ডোরাকাটা এবং পাশে সূচিকর্মের নানা নকশা করা থাকে । মাথায় স্কার্ফের মতো কাপড় দেয় ।
ধর্ম: চাকমারা প্রধানত বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। তাদের বৌদ্ধমন্দির বা বৌদ্ধবিহারের নাম ক্যাং। চাকমা অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামে ক্যাং প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রতিটি ক্যাং-এ একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন যিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। প্রদীপ জ্বেলে ফুল, ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য উপাচার সহযোগে তারা বুদ্ধের উপাসনা করে। চাকমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে হিন্দুধর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ঘরে ঘরে চাকমাদের মধ্যে গঙ্গাপূজা এবং লক্ষ্মীপূজার প্রচলন রয়েছে। গোজেন নামের ঈশ্বরকে তারা খুব ভক্তি করে। তারা রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি ও ফসল রক্ষার জন্য মোরগ ও শূকর বলিদান করে পূজা- অর্চনা করে। তারা মাঝে মাঝে ধর্মীয় সম্মেলনের আয়োজন করে। চাকমাদের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মানুষ অংশগ্রহণ করে। এছাড়া তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মাঘীপূর্ণিমা আড়ম্বরের সাথে পালন করা হয়।
চাকমা সম্প্রদায়ের পরিবর্তন:
ভারত বিভক্তির পর চাকমা সম্প্রদায়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এ পরিবর্তনের জন্য কয়েকটি উপাদান ভূমিকা রেখেছে। এগুলো হচ্ছে :
(ক) কেন্দ্রীয় প্রশাসন: বৃটিশ আমলে চাকমাসমাজ কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আওতাভুক্ত হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই পরিবর্তনের ফলে চাকমারা তাদের ঐতিহ্যগত নেতৃত্বের স্থলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রবর্তিত স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করতে থাকে। আগে কোনো সরকারি উন্নয়নমূলক কাজ ঐতিহ্যগত চাকমা-নেতৃত্বের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হত কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পর এর মাধ্যমেই সম্পাদন করা হয়।
(খ) শিক্ষা: চাকমা অধ্যুষিত গ্রাম ও শহর এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীসংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকাল আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় পেশা, যেমন: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, অধ্যাপক, ঠিকাদার, সরকারি ও বেসরকারি চাকুরিতে চাকমারা ক্রমবর্ধমান হারে সম্পৃক্ত হচ্ছে। শিক্ষার সম্প্রসারণের ফলে সামাজিক সচলতার হার অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(গ) ভূমিব্যবস্থার পরিবর্তন: চাকমাসমাজে ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানা না থাকার কারণে প্রাকৃতিক ভূমি যার যত খুশি অধিকার করে চাষ করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সর্বপ্রথম সমতলভূমি, জুম ও উদ্যান চাষের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেয়া শুরু করে। কাপ্তাই বাঁধের প্রভাবে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায়, সমতল ভূমির মানুষ পার্বত্য এলাকায় বসতি স্থাপন করায়, পর্যটন সম্প্রসারণের কারনে এবং চাকমা জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্বত্য ভূমির উপর চাপ বাড়ছে।
(ঘ) উৎপাদনকৌশল পরিবর্তন: চাকমাসমাজে উৎপাদনকৌশলে ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে জুমচাষ পদ্ধতির পরিবর্তে জুমচাষের পাশাপাশি সমতলভূমিতে হালচাষ এবং সরকারি উদ্যোগের ফলে উদ্যানচাষ বাড়ছে। পতিত জমির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
(ঙ) মুদ্রা অর্থনীতির প্রভাব: মুঘলযুগে এমনকি বৃটিশ আমলের শুরুর দিকে চাকমা সমাজে মুদ্রা-অর্থনীতির প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে মুদ্রা অর্থনীতি প্রসার লাভ করে এবং পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাহচর্য পেয়ে সমাজ আরও গতিশীল হয়। (চ) স্থানীয় বাঙালি সমাজের প্রভাব: বাঙালিদের সাথে মিথষ্ক্রিয়া বাড়ার ফলে চাকমা-বাঙালি সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় যা চাকমাসমাজে পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। বাঙালি সমাজের প্রভাবে চাকমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘরবাড়ির ধরন, আসবাবপত্র, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে।
(ছ) বৌদ্ধধর্মের প্রভাব: বিশ্ববৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাথে চাকমারা সম্পৃক্ত হচ্ছে এবং বিশ্ববৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি গোষ্ঠীর অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা শান্তিবাহিনী গঠন করে। পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র সংগ্রামের পর পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং তাদেরকে উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions