মারমা উপজাতি
‘ম্রাইমা' শব্দ থেকে মারমা শব্দটির উৎপত্তি। মারমারা ‘মগ’ নামেও পরিচিত। মারমা নৃগোষ্ঠী বাংলাদেশের একটি অন্যতম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যাদের অধিকাংশই পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। সংখ্যার দিক থেকে মারমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মারমা নৃগোষ্ঠীর ২,০২,৯৭৪ জন মানুষ বসবাস করেন ।
আবাস ও ভাষা: মারমারা মূলত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় বসবাস করে। তিন পার্বত্য জেলায় তাদের বসবাস পরিলক্ষিত হলেও মূল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ বান্দরবান জেলায় বসবাস করে। এর বাইরে পটুয়াখালি ও কক্সবাজার জেলাও তারা বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ মারমারাই মায়ানমার থেকে আগত। বাংলাদেশ ছাড়াও এ জনগোষ্ঠী ভারত ও মায়ানমারেও বসবাস করে। মারমাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে বার্মিজ সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। মারমারা লেখালেখির ক্ষেত্রে তারা বার্মিজ বর্ণমালা ব্যবহার করে। মারমাদের ভাষা তিব্বত-বার্মা ভাষাসমূহের অধীনে বার্মা-আরাকান শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। তবে সাম্প্রতিককালে মারমারা বাংলা ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাও ব্যবহার করে থাকে। মারমারা বার্মিজ ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে থাকে। তাদের নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানকে সাংগ্রাই বলা হয়।
জাতিগত উৎপত্তিঃ মারমারা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। তারা মূলত মায়ানমারের আরাকানিদের বংশধর। মারমা সম্প্রদায়ের গয়ের রঙ হলদে ফর্সা, উচ্চতা তুলনামূলকভাবে খাটো, নাক বোঁচা, কালো চুল ও ছোট চোখ। ১৪ থেকে ১৭ শতকে বার্মিজরা আরাকান জয় করলে মারমারা আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়। তখন তারা থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে। মায়ানমারের প্রাচীন পেগুসিটি হল মারমা সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান।
বিবাহ ও পরিবার ব্যবস্থা: মারমাদের পরিবার ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। মারমা পরিবারের প্রধান পিতা হলেও পারিবারিক কাজকর্মে মাতার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষটি মারমা পরিবারের প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করে। মারমা পরিবার সাধারণত একক পরিবার। পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে তারা প্রাচীন বার্মিজ প্রথা অনুসরণ করে যাকে ‘থামোতাদা' (Thamohada) বলা হয়। পুত্র এবং কন্যা যে কেউই পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে । সাধারণত সবচেয়ে প্রিয় সন্তানটিই গৃহের মালিকানা লাভ করে এবং পিতামাতাকে দেখাশোনা করে। মারমা সম্প্রদায়ে সাধারণত একবিবাহ ব্যবস্থাই প্রচলিত। তবে বহুবিবাহ প্রথা ও দেখা যায়। নারী এবং পুরুষ উভয়েরই বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে হেডম্যান বা কারবারির বিচারই চূড়ান্ত। মারমা সমাজে অন্তর্বিবাহ ও বহির্বিবাহ দুই ধরনের বিবাহ প্রথাই প্রচলিত । বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও সম্পত্তির মালিকানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মারমরা নারীদেরকে স্বাধীনতা দেয়।
ধর্ম: মারমারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। প্রায় প্রত্যেকটি মারমা গ্রামে বৌদ্ধ বিহার ‘কিয়াং’ এবং বৌদ্ধভিক্ষু “ভান্তে’দের অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। মারমারা বৈশাখী পূর্ণিমা, আশ্বিনী পূর্ণিমা, কার্তিকী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা প্রভৃতি বিশেষ দিনগুলোতে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ফুল দিয়ে ও প্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের বন্দনা করে থাকে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধদের মত মারমারাও Theravada Buddhism-এ বিশ্বাসী। তারা বিভিন্ন দেবতার অর্চনা করে থাকে। মারমা নৃগোষ্ঠীর একটি অংশ সর্বপ্রাণবাদ (Animism) চর্চা করে, যাদের ধর্মীয় গ্রন্থের নাম “খাদুত্যিয়াং” (Khaduttiang)। মারমারা অতিপ্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাস করে। এজন্য তারা বিভিন্ন রীতি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ শক্তিকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে।
অর্থনীতি: কৃষি নির্ভর মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান পেশা কৃষি। সাধারণত তারা জুমচাষ করে। মারমা নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বসতবাড়িভিত্তিক ছোট আকারের বাগানকৃষি দেখা যায়। এছাড়াও তারা ঝুড়ি এবং চোলাই মদ তৈরি করে। মারমা নারীরা বস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী।
রাজনৈতিক সংগঠন: মারমা সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত। মারমা সমাজের প্রধান হলেন বোমাং চিফ বা বোমাং রাজা। মারমা সমাজ কতগুলো মৌজায় বিভক্ত। প্রত্যেক মৌজায় কতগুলো গ্রাম রয়েছে। মারমা ভাষায় এ গ্রামকে বলা হয় ‘রোয়া’। গ্রামবাসী দ্বারা গ্রামের প্রধান মনোনীত হয়, যাকে 'রোয়াজা' বলা হয়। মারমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবে ত্রিমাত্রিক। তাদের গ্রাম/পাড়া, মৌজা এবং সার্কেলের প্রধানকে যথাক্রমে কারবারি, হেডম্যান এবং রাজা বা সার্কেল চিফ বলা হয়। এই প্রশাসনিক প্রধানগণ আইন প্রয়োগ, ঝগড়া-বিবাদ মিমাংসা এবং সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করেন।
খাদ্যাভ্যাস, স্থাপত্যরীতি ও পোশাক: মারমারা ভাত, মাছ, মাংস এবং নানা ধরনের শাক-সবজি খেয়ে থাকে। সিদ্ধ শাক- সবজির সাথে মরিচ মিশিয়ে প্রস্তুত করা ‘তোহজা' তাদের একটি প্রিয় খাবার। শুটকি মাছ থেকে প্রস্তুতকৃত ‘নাপ্পি' বা ‘আওয়াংপি’ তাদের আরেকটি পছন্দের খাবার। মারমারা বাঁশ, কাঠ ও ছন দিয়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। কয়েকটি বাঁশের খুঁটির উপর মাটি থেকে ৬-৭ ফুট উপরে তাদের ঘরবাড়ি নির্মিত হয়। বাঁশ বা কাঠের উঁচু ভিতের উপর নির্মিত ঘরবাড়িকে ‘মাচাং' বলা হয়। গৃহপালিত পশু রাখা, জ্বালানি কাঠ সংরক্ষণ, জুমের ফসল রাখা ইত্যাদি কাজে তারা মাচাং ব্যবহার করে থাকে । মারমা নারী পুরুষেরা পোশাক পরিচ্ছদে পরিপাটি। মারমা পুরুষেরা গায়ে জামা ও লুঙ্গি পরে। পুরুষেরা মাথায় ‘গবং’ নামক পাগড়ি পরে। মারমা নারীরা ‘আনিঞ্জ' নামক এক ধরনের ব্লাউজ পরে। এছাড়াও মারমা নারীরা ‘রাংকাই' ও ‘থামি’ নামের দুটি বিশেষ ধরনের পোশাক পরে থাকে। বর্তমানে মারমা নারীও পুরুষ উভয়েই লুঙ্গি পরে থাকে। মারমারা ঐতিহ্যবাহী বুনন প্রযুক্তির সাহায্যে নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে থাকে ।
মারমা সম্প্রদায়ের পরিবর্তন: গত কয়েক দশকে মারমা সম্প্রদায়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। যেসব কারণে চাকমাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে সেসব কারণে মারমা সম্প্রদায়েও পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে, শিক্ষা, নগরায়ন, মুদ্রা ও বাজার অর্থনীতি, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নতি, শান্তি চুক্তিসহ সরকারি নানা উদ্যোগ মারমা সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions