ইমাম শাফেয়ীর জীবনী
যে সমস্ত মনীষীর আপ্রাণ চেষ্টায় ইসলামি ফিক্হ শাস্ত্রের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে ইমাম শাফিঈ (র) তাঁদের অন্যতম। তিনি শাফিঈ মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে সমন্বয় সাধন করে তিনি শক্তিশালী মতামত উপস্থাপন করেন।
ইমাম শাফিঈর (র) পূর্ণ নাম হলো আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইদরীস আশ-শাফিঈ। তাঁর ঊর্ধ্বতন বংশসূত্র কুরাইশ নেতা কুসাই-এর সঙ্গে সংযুক্ত । তিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত হাশিমী শেখার লোক ছিলেন। তিনি বর্তমান ইসরাঈল দখলীকৃত ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ১৫০ হিজরি সনে (৭৬৭ খ্রি:) জন্মগ্রহণ করেন।
দু'বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা মারা গেলে তাঁর মাতা উম্মুল হাসান গাজা ছেড়ে তাঁকে নিয়ে মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন। মক্কাতেই তিনি লালিত-পালিত হন। কুরআন মাজীদ নিয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি দশ বছর ধরে মক্কার বিখ্যাত হুযায়ল গোত্রে বসবাস করে আরবি ভাষা, সাহিত্য ও কাব্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
ইমাম শাফিঈ (র) দশ বছর বয়সে পূর্ণ কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেছিলেন। তিনি মক্কার প্রসিদ্ধ মুফতি মুসলিম ইবন খালিদ যানজীর নিকট থেকে ফিক্হ শিক্ষা লাভ করেন ।
তিনি পনের বছর বয়সে ফাতাওয়া দেওয়া শুরু করেন। তারপর তিনি মদীনায় উপস্থিত হয়ে সরাসরি ইমাম মালিক (র)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার প্রণীত মুয়াত্তা তাকে শুনান। তিনি ইমাম মালিক (র)-এর নিকট থেকে বিপুল পরিমাণে ফিক্হ শাস্ত্রের ওপর জ্ঞান হাসিল করেছিলেন। ইমাম মালিক (র) তাঁর অপূর্ব মেধা, অনন্য ধীশক্তি ও অবিস্মরণীয় অধ্যয়ন পিপাসা দেখতে পেয়ে তাঁকে অত্যধিক সম্মান ও স্নেহ করতেন। তিনি অন্যান্য বিখ্যাত ফিক্হ শাস্ত্রবিদদের নিকট থেকেও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
এই জগদ্বিখ্যাত ইসলামি আইন প্রণেতা ২০৪ হিজরি সনের রজব মাসের শেষ দিন (২০ জানুয়ারি ৮২০ খ্রি:) ফুসতাতে মৃত্যুবরণ করেন । তাঁকে মোকাত্তাম পর্বতের পাদদেশে সমাহিত করা হয়।
ইমাম শাফিঈর (র) অবদান
ইসলামি আইনশাস্ত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা হলো-
ইমাম শাফিঈ (রহ.) শিয়া মতবাদ প্রচারের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৮৭ হিজরি সনে। তাঁকে বাগদাদে খলিফা হারুন আর-রশীদের দরবারে হাজির করা হলে দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ফজল ইবন রাবি-এর সুপারিশে মুক্তি দেওয়া হয় ।
ইমাম শাফিঈ ১৮৮ হি সনে মক্কা, সিরিয়া হয়ে মিসরে উপস্থিত হন এবং ইমাম মালিকের শিষ্য হওয়ার সুবাদে মিসরের লোকজন তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫ হিজরি পর্যন্ত মিসরে অবস্থান করার পর পুনরায় ইরাকে গমন করেন এবং সেখানে অনেক দিন অতিবাহিত করেন।
হিজরি ১৯৫ সনে ইরাকে অবস্থানকালে সেখানকার আলিম-উলামা তাঁর শিক্ষা গ্রহণ ও যথার্থ সম্মানে অধিষ্ঠিত করেন । তিনি সেখানকার আলিমগণের সহযোগিতায় হানাফি ও মালিকি মাযহাবের নির্যাস নিয়ে একটি মাযহাব প্রবর্তন করেন। ইতিহাসে একে শাফিঈ মাযহাব বলা হয়।
ইমাম শাফিঈ (র) কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান না দিতে পারলে কিয়াসের সাহায্য গ্রহণ করতেন। তাঁকেই ইসলামি ফিক্হশাস্ত্রে সর্বপ্রথম কিয়াসের ব্যবহারকারী হিসাবে ধরা হয়।
ইমাম শাফিঈ (র) ফিক্হ ও হাদিস শাস্ত্রের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। তিনি নিজকে বড় মাপের হাদিস ও ফিক্হ বিশারদরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তাঁর ছাত্র ইমাম আহমদ (র) বলেন, “হাদিস বিশারদগণ ঘুমন্ত ছিলেন, ইমাম শাফিঈ (র) তাদের জাগিয়ে তোলেন।”
ইমাম শাফিঈ (র) ফিক্হ শাস্ত্রের গবেষণা ও চিন্তা ভাবনায় অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। তাঁর নিকট যা সঠিক বলে মনে হতো ঠিক তাই গ্রহণ করতেন। তিনি মূলত হানাফি ও মালিকি মাযহাবের মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে শাফিঈ মাযহাবের ভিত্তি নির্মাণ করেন ।
উসূলে ফিক্হর সুশৃঙ্খল নিয়মাবলির উদ্ভাবনে ইমাম শাফিঈ যে অবদান রেখেছিলেন তা অন্য কোন ফকিহর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের ওপর ভর করেই পরবর্তীকালের ফিক্হ গবেষকগণ সামনে এগিয়ে যান।
ইমাম শাফিঈ একমাত্র ব্যক্তি যিনি ফিক্হ পন্থী (Billal) এবং হাদিস পন্থীদের (banol) মাঝে দূরত্ব কমিয়ে একই সমতলে অবস্থান করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি এদেরকে কাছাকাছি নিয়ে এসে উভয়ের মাঝে এক মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেন ।
তিনি মূলত হাদিসের মধ্যে পারস্পরিক বাহ্যিক হুকুমের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন করেন। তিনি হাদিসের বাণীগুলোকে আইনের উৎস হিসেবে মনে করেন। তিনি কুরআন ও হাদিসের সাথে কোন রূপ পার্থক্য আনতে নারাজ ।
ইমাম আবু হানিফা (র)-এর প্রচেষ্টায় ফিক্হ শাস্ত্র বিষয়ক মূলনীতির প্রসার ঘটলেও তা সুবিন্যস্ত ও সুসংহতভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ইমাম শাফিঈ (র)। আর এ কারণেই তাঁকে ফিক্হ-বিজ্ঞান বা উসূলে ফিক্হর প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় ।
ইমাম শাফিঈ (র) তাঁর বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে বাহ্যত বিরোধী হাদিসগুলোর সুনিপুণ সমাধান করেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ ইখতিলাফুল হাদিসে (।) পরস্পর বিরোধী হাদিসগুলো এমনভাবে সমন্বিত করেছেন যে, দুটি হাদিস থেকে দুটি মত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তার এ গ্রন্থটি সুধী মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিল।
শাফিঈ মাযহাবের বৈশিষ্ট্য
১. আইন নির্ণয়ে কুরআনকে সর্বাগ্রে গ্রহণ ।
২. কুরআন-হাদিসের প্রকাশ্য অর্থের প্রয়োগে বিশ্বাসী ছিলেন।
৩. দ্বিতীয় পর্যায়ে হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করতেন।
৪. হাদিসকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করার ব্যাপারে কোন শর্তারোপ করেননি ।
৫. হাদিসের পর ইজমা গ্রহণ করতেন ।
৬. ইতিহসান ও ইসতিসলাহ মানেননি বরং ইতিদলাল পদ্ধতি গ্রহণ করে ফিক্হ রচনা করেছেন। ৭. কিয়াসকে আনুপাতিক হারে কম গ্রহণ করতেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions