হযরত শাইখ আহমদ সিরহিন্দি (র)
হযরত শাইখ আহমদ সিরহিন্দি (র.) ছিলেন এ উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলিম, বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা, বিশ্ববিখ্যাত সংস্কারক ও সাধক। তাঁর নিষ্ঠা, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ।
তাঁর প্রকৃত নাম আবুল বারাকাত বদরুদ্দীন। পিতার নাম শাইখ আহমদ আহাদ। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) -এর ২৮তম অধস্তন বংশধর ছিলেন। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব এলাকার সিরহিন্দ নামক স্থানে ১৪ শাওয়াল ১৯৭১ হিজরি মোতাবেক ২৬ মে ১৫৬৪ খ্রি. শুক্রবার দিন তিনি জন্ম লাভ করেন ।
শিশু বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন হিফ্য করেন। তাঁর পিতা একজন বিখ্যাত আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন। পিতার কাছেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ১০ বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কানপুর গমন করেন। তিনি সেখানে দশ বছর অবস্থান করে বিখ্যাত আলিমগণের নিকট হতে কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিক্হ, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ইসলামের একজন খ্যাতনামা পণ্ডিত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মাত্র ১৭ বৎসর বয়সে তিনি কানপুর মাদ্রাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁর নিকট শিক্ষা লাভের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য জ্ঞান পিপাসু আসতে থাকে ।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে (১) মায়ারিফ-ই-লাদুনিয়্যা (২) রিসালা-ই-মাবদা ওয়া মাআদ (৩) মুকাশিফাত-ই- গায়রিয়া (৪) শরহি রুবাইয়াত (৫) রিসালায়ে রদ্দে রাওয়াফিয (৬) মাকতুবাত শরীফ ইত্যাদি।
ধর্মীয় সংস্কার সাধন
তাঁর সময়ে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে শিরক, বিদআত ও নানারূপ কুসংস্কারের প্রচলন ঘটেছিল। তখন মুসলিম শাসকগণ স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে দেশ চালাতেন। তারা দেশে ইসলাম পরিপন্থী নানা রূপ রীতিনীতি চালু করেছিলেন। শায়খ আহমদ সিরহিন্দি এসব দেখে চুপচাপ বসে থাকতে পারেন নি। তিনি দেশে প্রচলিত কুসংস্কারের অসারতা প্রমাণ করে প্রকৃত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে এ ভূখণ্ডে প্রকৃত ইসলাম স্থায়িত্ব লাভ করে।
সে সময় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজ মোটেও সহজ ছিল না। সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রচারিত দ্বীন-ই-ইলাহির বিরোধিতা করায় দীর্ঘদিন তাঁকে কারাগারে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এত নির্যাতনের মধ্যেও তিনি থেমে যাননি। বরং তিনি সংস্কারমূলক কাজ চালিয়ে যান। তখন গোয়ালিয়রের কারাগারে যত বন্দী রাখা ছিল তারা সবাই শাইখ আহমদ সিরহিন্দির ভক্ত ও অনুরক্ত হয়ে গিয়েছিলো। এভাবে কারাগারে থাকতেই ইসলামের এক বিরাট বিপ্লব সৃষ্টি হলো ।
আধ্যাত্মিক সাধনা
শাইখ আহমদ সিরহিন্দির ছিলেন মূলত একজন সংগ্রামী সমাজ সংস্কারক। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক সাধকও ছিলেন। শরী'আতের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি তাঁর পিতার নিকট আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি দিল্লির বিখ্যাত পীর হযরত বাকী বিল্লাহর নিকট মুরিদ হন। তিনি তাঁর তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন ।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি খাদেমদেরকে বলেন, “তোমরা আমার জন্য অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করেছ। শুধু আজকের রাতটা আরও একটু কষ্ট স্বীকার কর। এরপর হয়ত আর করতে হবে না।” শেষ রাতে উঠে উযু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে বিছানায় বসেই বলেন, “এটাই আমার শেষ তাহাজ্জুদের নামায পড়া হলো ; হয়তো আর জীবনে কখনো ঘটবে না।” সেদিন ফজরের নামায জামায়াতে আদায় করে মোরাকাবা-মোশাহাদায় বসলেন এবং জীবনের শেষ নামায সেদিনই পড়েছিলেন।
ইন্তেকাল
বাংলাদেশ-পাক-ভারতের একজন সাধক, সংস্কারক ও সংগ্রামী আলিম ৬৩ বছর বয়সে ২৮ সফল ১০৩৪ হিজরি মোতাবেক ৩০ নভেম্বর ১৬২৪ খ্রি. বুধবার সিরহিন্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশ এক মহান সাধক হারালো ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions