হযরত আদম (আঃ) এর সৃষ্টির ঘটনা
আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। এ পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠাই মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য। হযরত আদম (আ) ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানব ও প্রথম নবী। তাঁরই পাঁজর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রথম মানবী হযরত হাওয়া (আ)-কে তাঁর সঙ্গী হিসেবে। আর স্ত্রী থেকেই পৃথিবীতে মানব জাতির বংশ বিস্তার শুরু হয়। মানব জাতির ইতিহাসে হযরত আদম ও হাওয়া (আ)-এর সৃষ্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিধিরূপে মানব জাতি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত ফেরেশতদের নিকট জানাতে গিয়ে বলেন :
إنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةٌ
“আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই।” (সূরা আল-বাকারা ২ : ৩০)
যখন আল্লাহ তা'আলা পৃথিবীতে মানব জাতিকে প্রতিনিধিরূপে সৃষ্টির সিদ্ধান্ত জানালেন তখন ফেরেশতাগণ ইতোপূর্বকার পৃথিবীতে বসবাসকারী জিন জাতিকে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ, হত্যা-কলহ এবং অধঃপতন সম্পর্কিত পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে মানব জাতিও পৃথিবীতে এসে পরস্পর কলহ-বিবাদ ও রক্তপাত ঘটাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন। মহান আল্লাহর নিকট নিজেদের অভিমত প্রকাশ করে আরয করলেন :
و نحن نسبح بحمدك ونقدسُ لَكَ
“আমরাই তো আপনার প্রশংসা, গুণকীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।” (সূরা আল-বাকারা ২ : ৩০)
তাঁদের ধারণা ছিল মহান আল্লাহর গুণগান ও পবিত্রতা ঘোষণার জন্য তাঁরাই যথেষ্ট। সুতরাং মানব সৃষ্টির দরকার নেই। আল্লাহ তা'আলা তাঁদের এ বক্তেব্যের জবাবে বলেন-
إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
“আমি জানি, তোমরা যা জান না।” (সূরা আল-বাকারা ২ : ৩০)
আল্লাহ তা'আলা তখনই ফেরেশতাদেরকে মানব জাতি সৃষ্টির রহস্য ও সার্থকতা সম্পর্কে কিছু না জানিয়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী ফেরেশতা জিবরাঈল কর্তৃক পৃথিবীর সকল অঞ্চল হতে প্রত্যেক প্রকার মাটি সংগ্রহ করান। তারপর জান্নাতের ঝরণার পানি মিশ্রিত মাটি দিয়ে তাঁর মনোনীত খিলাফতের জন্য যোগ্যতম আকৃতিতে আদমের (আ) দেহের কাঠামো তৈরি করলেন। এরপর তাতে রূহ সঞ্চারিত করলে হযরত আদম (আ) প্রাণময় হয়ে উঠেন ।
মহান আল্লাহ হযরত আদম (আ)-কে খিলাফতের জন্য যোগ্যরূপে গড়ে তোলার জন্য যাবতীয় বস্তুর নাম, তথ্য ও তত্ত্ব শেখালেন। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা সে সমস্ত বস্তু হযরত আদম (আ) ও ফেরেশতাদের সামনে উপস্থিত করেন। ফেরেশতাদেরকে সেগুলোর নাম বলতে আদেশ করেন। ফেরেশতাগণ সেগুলোর নাম বলতে অক্ষমতা প্রকাশ করে নিবেদন করলেন,
سبْحَنَكَ لا علم لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا
“আপনি মহান পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই।” (সূরা আল-বাকারা ২ : ৩২)
অতঃপর মহান আল্লাহ আদম (আ)-কে সেগুলোর নাম ও তথ্যাদি বলতে বললে তিনি সব বস্তুর নাম বলে দিলেন। এতে প্রমাণ হয়ে গেল জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে ও খিলাফত পরিচালনার জন্য হযরত আদম (আ)-ই উপযুক্ত এবং শ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে হযরত আদম (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে তাঁকে সম্মানসূচক সিজদা করতে আদেশ দিলেন। ইবলিস ব্যতীত সকল ফেরেশতা আল্লাহর আদেশ পালন করলেন। আগুনের তৈরি ইবলিস অহঙ্কার-বশত মাটির তৈরি আদম (আ) কে সিজদা করতে অস্বীকার করলো। সে আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করল। ফলে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয় ।
মহান আল্লাহ হযরত আদম (আ)-এর প্রশান্তি দানের জন্য তাঁর বাম পাঁজর হতে উপাদান নিয়ে তাঁর জুড়ি হযরত হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করলেন। উভয়কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে জান্নাতে অবস্থানের এবং তার ফলফলাদি ইচ্ছানুযায়ী ভক্ষণ করার কথা বললেন। আর একটি বৃক্ষ দেখিয়ে বললেন, কখনো এর কাছে যেও না।
জান্নাতের মধ্যে হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ) পরম সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। ইবলিসের এটা সহ্য হলো না। ইবলিস বন্ধুবেশে হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-কে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়াতে চেষ্টা করে। শেষে ইবলিস সফল হয়। তাঁরা উভয়ে ফল খেয়ে ফেলেন। এ ভুলের কারণে তাঁরা আল্লাহর বিরাগভাজন হলেন। উভয়ের দেহ হতে জান্নাতি পোশাক খসে পড়ে যায়। ও সঙ্কুচিত অবস্থায় তারা গাছের পাতা দ্বারা অঙ্গ ঢেকে লজ্জা নিবারণ করার চেষ্টা করেন।
এরপর আল্লাহ তাঁদেরকে জান্নাত হতে বের করে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন। হযরত আদম (আ) বর্তমান শ্রীলংকা ও হাওয়া (আ) জেদ্দায় পতিত হন। হযরত আদম ও হাওয়া (আ)- কে পৃথিবীর দু'প্রান্তে প্রেরণ করা হলে তাঁরা দীর্ঘদিন কান্নাকাটি ও তাওবা করলেন । তাঁরা আল্লাহর কাছ থেকে একটি দু'আ শিখে নিয়েছিলেন। তাঁরা সেই দু'আ পড়তে থাকলেন এবং নিজের ভুলের জন্য কান্নাকাটি করেন। এমনিভাবে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পর করুণাময় মহান আল্লাহ তাঁদের তাওবা মঞ্জুর করে অপরাধ মাফ করে দিলেন। এরপর আল্লাহর ইশারায় হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর মধ্যে মক্কার আরাফাত ময়দানে সাক্ষাৎ ও পুনর্মিলন ঘটে। অতঃপর তারা পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। তাঁদের ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানব বংশ বিস্তার লাভ করে ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions