ইউসেপ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে থাকা অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের মৌলিক শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে নিউজিল্যান্ডের মানবপ্রেমিক লিনডসে অ্যালন চেনি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন UCEP বা Under Privleged children's Educational Program। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে ইউসেপ। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ে দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় এলাকার মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিউজিল্যান্ড থেকে লিন্ডসে অ্যালেন শেইন নামে একজন সেবাকর্মী ব্রিটিশ ত্রাণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে এদেশে আসেন। ত্রাণ কর্মতৎপরতার পাশাপাশি তিনি বঞ্চিত, গৃহহীন, দরিদ্র শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরকে সহযোগিতা করেন। পরিকল্পনাটি তৈরি হলে তিনি তা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংস্থানের সন্ধানে নেমে পড়েন। ডেনমার্ক সরকার তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আর্থিক সহায়তাসহ একটি তিনবছর মেয়াদি প্রকল্প অনুমোদন করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে প্রকল্পের কার্যালয়ের জন্য
বাড়ি বরাদ্দ দেয়। উল্লিখিত কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে ইউসেপ নামের এনজিও প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমাজকল্যাণ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর অধীনে ১৯৮৮ সালে ইউসেপ একটি জাতীয় এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা, প্রশিক্ষণ প্রদান, কারিগরী দক্ষতা অর্জন ও কাজের সুযোগ তৈরি করা এর অন্যতম কাজ। ইউসেপের অধীনে ৫৩ টি স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষা দেয়া হয় শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের মাত্র ৩.৫ বছরে। ইউসেপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনষ্টিটিউটের আওতায় চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা করার সুযোগ আছে। বর্তমানে ইউসেপে ১২৭৭ জন চাকুরিজীবী (যাদের ৩২ শতাংশ নারী)। ইউসেপের বর্তমানে ৬৪ টি স্কুলের মধ্যে ১০ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান,৪৪টা সাধারণ স্কুল। ইউসেপের এসকল প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই নিজস্ব জমিতে অবস্থিত। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইউসেপ বাংলাদেশ'র ভিশন হলো- সমাজে এমন একটা সুন্দর পরিবেশ ও পরিচালনা কাঠামো গড়ে তোলা যেখানে প্রত্যেক শিশু তাদের সম্ভাবনার বিকাশ এবং কোনোরকম বৈষম্য ছাড়া অনুকূল পরিবেশে নিজেদের তৈরি করতে পারবে।
ইউসেপ বাংলাদেশ'র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো:
ক. বাংলাদেশের শহরে এবং শহরের কাছকাছি এলাকায় কর্মরত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, সচেতনতা, এ্যাডভোকেসি এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন করা;
খ. দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;
গ. বর্ধিত সক্ষমতা এবং মর্যাদার মাধ্যমে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা;
ঘ. শহুরে দরিদ্রদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা;
ঙ. শহুরে দরিদ্রদের অধিকার আদায়ে সক্ষম করে তোলা;
চ. মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক সংস্থাসমূহের নেতৃত্ব প্রদান করা; এবং
ছ. বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
ইউসেপ বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ১৯৭২ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত, হতদরিদ্র, বস্তিবাসী, শ্রমজীবী ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ তথা উপার্জনের জন্য দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী ইউসেপ বাংলাদেশ ১০ টি জেলায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ৬৩ টি স্কুল রয়েছে (৫৩ টি সাধারণ, ১০ টি টেকনিক্যাল) এসব স্কুলে ৫৫,০০০ এর বেশি ছেলেমেয়েকে প্রতিবছর শিক্ষা লাভ করতে সহায়তা করা হয়।
ইউসেপ বাংলাদেশ'র কার্যক্রম
ইউসেপ বাংলাদেশ'র কার্যক্রমগুলো চারটি ভাগে নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১। শিক্ষা কার্যক্রম:
ইউসেপ এর সবচেয়ে বড় কার্যক্রম হলো শিক্ষা কার্যক্রম। অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম দু'ভাবে পরিচালিত হয় যা নিম্নরুপ:
ক. সমন্বিত সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা: সমন্বিত সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার কর্মসূচির আওতায় ইউসেপ বিনামূল্যে অবহেলিত শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ইউসেপের অধীনে পরিচালিত ৪৪ টি সাধারণ স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে এই শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণ ইউসেপ স্কুলগুলো জাতীয় শিক্ষাদানের সিলেবাস অনুসরণ করে তবে তা দ্রততম ও সহজ উপায়ে শিক্ষা দান করা হয়। ২০১৪ সালে এ কার্যক্রমের আওতায় ৪৩,৭১৮ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে যার মধ্যে ৪৯ শতাংশ ছাত্রী। সমন্বিত সাধারণ ও কারিগরি কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শিশু বাছাই প্রক্রিয়া মানসম্মত করা, একাডেমিক পরিকল্পনা, স্কুল মনিটরিং, সুন্দর ক্লাসরুম, সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষদের দক্ষতা বৃদ্ধি। এ কর্মসূচির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নারী শিক্ষার জন্য সচেতনতা তৈরি করা। কন্যা সন্তানের মা-বাবা যেন তার সন্তানকে স্কুলে পাঠায় এ সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরির ক্যাম্পেইন চলছে। এ কর্মসূচীর আওতায় ১০ হাজারের বেশী শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৯১.৮৮ শতাংশ কৃতকার্য হয়েছে। সাধারন স্কুলের ক্লাসগুলো প্রতিদিন ৩ শিফটে পরিচালিত হয় এবং প্রতিটি শিফটের জন্য ৩ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ থাকে। শিফট এ ক্লাস পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য হলো যতবেশী শ্রমজীবী শিশুদের সম্পৃক্ত করা যায়।
খ. কারিগরি শিক্ষা: ইউসেপ বাংলাদেশ অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ আনুষ্ঠানিক এবং ডিপ্লোমা কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। স্বল্পমেয়াদি কারিগরী শিক্ষার আওতায় ইউসেপ ৩-১২ মাসের কোর্স পরিচালনা করে থাকে। আনুষ্ঠানিক কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয় এস.এস.সি. পর্যন্ত। শুরু হয় ৮ম শ্রেণিতে শেষ হয় এস.এস.সিতে। এছাড়াও ইউসেপ ০৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ইউসেপের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ৩ টি টেকনিক্যাল স্কুল রয়েছে ঢাকা, খুলনা এবং চট্টগ্রামে। মোট ২৯ টি ট্রেড এ শিক্ষা দেয়া হয় । যারা এসব ট্রেড এ ভালো করে তাদের এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। অটোমেকানিক, ওয়েন্ডিং এ্যান্ড ফেব্রিকেশন, ইলেকট্রনিক্স, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইত্যাদি ট্রেডগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ছাত্র (এর মধ্যে ৬২৪ জন্য কারিগরি বিভাগ থেকে এস.এস.সি পাশ করেছে) কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করেছে যেখানে ছেলে মেয়ের অনুপাত হলো ৬২:৩৮ । গবেষণায় দেখা গেছে ইউসেপ থেকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীর ৩৮ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক উপার্জনে নিয়োজিত ।
২. দক্ষতা প্রশিক্ষণঃ
টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে ৩০ টি ট্রেডভিত্তিক এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব প্রশিক্ষণের মধ্যে অনেকগুলোতে সিবিটিএ (কম্পিটেন্সি বেইস ট্রেইনিং এ্যাসেসমেন্ট)। অর্থাৎ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ২০১৫ সালের এস.এস.সি. ভোকেশনাল বিভাগে শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জায়গা করে নেয় ইউসেপ পরিচালিত প্রশিক্ষণ ভিত্তিক এ কর্মসূচি। ২০১৪ সালে ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল সরকারি এ্যাক্রিডেটশন পায়।
৩. এ্যাডভোকেসি:
২০০৭ সাল থেকে ইউসেপ বাংলাদেশ নারী ও শিশু অধিকার এ্যাডভোকেসি নামে কর্মসূচি চালু করে । এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্যে হলো নারী ও শিশু অধিকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। ইউসেপ বাংলাদেশ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহয়তায় এ কর্মসূচি পরিচালনা করে। ২০১৫ সালে এ কর্মসূচির লক্ষ্যগুলো ছিলো: ক. মেয়েদের শিক্ষায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার কার্যক্রমকে আরো বেশি গতিশীল করা;
খ. অন্যান্য স্কুলের সাথে পার্টনারসিপ গড়ে তোলা যাতে অধিকসংখ্যক শিশু বিশেষ করে মেয়েশিশু টেকনিক্যাল স্কুল গুলোতে আসে; এবং
গ. শিশুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে পরিবার, কমিউনিটি, কর্মজীবী এবং অন্যান্য সংস্থার আর্থিক/কারিগরি/কৌশলগত সমর্থন ও সহযোগিতা বৃদ্ধি ।
৪. কর্মসংস্থান সহায়তা সেবা:
ইউসেপ বাংলাদেশ'র অন্যতম উদ্দেশ্য হলো যেসব সুবিধাবঞ্চিত ছেলে মেয়ে ইউসেপ পরিচালিত স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা করা শুধুমাত্র চাকুরি খোঁজার ক্ষেত্রে নয়, কীভাবে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায় সে ব্যাপারে ইউসেপ সদা তৎপর। ২০১৪ সালে ৬ হাজার ইউসেপ গ্রাজুয়েট বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পেয়েছে। ইউসেপ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের চাকুরি পাওয়ার হার ৯০.৮ শতাংশ যাদের ৯৯ শতাংশ চাকুরি শুরু করে ৬,০০০/- টাকা মাসিক বেতনে ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions