গ্রামীণ ব্যাংক কি
গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাছে জামানত বিহীন ঋণসুবিধা পৌঁছানো, মহাজনের অত্যাচার থেকে দরিদ্র মানুষদের রক্ষা, ভূমিহীন মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তোলা এবং দুঃস্থ ও দরিদ্র পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় । গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। গ্রামীণ ব্যাংক হচ্ছে পল্লীর ভূমিহীন দরিদ্র পুরুষ ও মহিলাদের ঋণদানের জন্য একটি বিশেষ অর্থলগ্নীকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করার পূর্বে ড. মোহাম্মদ ইউনুস সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জেলায় জোবরা গ্রামের জামানত হীনভাবে কৃষকদের ঋণ প্রদান করেন। ঋণ প্রদান করার এ প্রায়োগিক প্রকল্পের সফলতাই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জোগায়। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক নির্ধারিত কিছু জেলায় তার কার্যক্রম প্রসারিত করে । গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এর মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রামীণ ব্যাংক স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশেষ অর্থলগ্নকারী প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত এ ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০৮১ মিলিয়ন, যার ৯৭ শতাংশ নারী। গ্রামীণ ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক তার ২৫৬৮ শাখার মাধ্যমে প্রায় ৮১.৩৯২টি গ্রামে ঋণসেবা পৌছে দিচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা, কর্মকাণ্ড এবং সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে ।
গ্রামীণ ব্যাংকের কতিপয় উদ্দেশ্য রয়েছে সেগুলো হলো:
১. দরিদ্র নারী-পুরুষদের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা নিশ্চিত করা;
২. সুদখোর, মহাজনদের শোষণ ও বঞ্চনার বিলোপ সাধন;
৩. বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ তৈরি করা;
৪. অবহেলিত গ্রামীণ দরিদ্র নারীদেরকে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনা, যা তাদের জন্য বোধগম্য হবে এবং তারা তা ব্যবস্থা করতে পারবে;
৫. মজুরভিত্তিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে পার্শ্বজীবকিার সুযোগ সৃষ্টি করা;
৬. কম আয়, কম সঞ্চয় এবং কম বিনিয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র্যের যে অতি পুরাতন দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলা;
৭. উৎপাদনশীল ও সঞ্চয়মূলক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা; এবং
৮. বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও আর্থিক উৎপার্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্যের দৃষ্টান্ত দূরীভূত করা ।
গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে পারস্পরিক আস্থা, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ ও সৃজনশীলতার উপর ভিত্তি করে জামানত ছাড়া ঋণদানের নতুন ব্যাংকিং ব্যবস্থা এগিয়ে নিয়ে চলছে। গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জামানতবিহীন ঋণদান করে। যেসব অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের কারণে ব্যাংকিং সেবার বাইরে ছিলো গ্রামীণ ব্যাংক যেসব অতিদরিদ্র মানুষকে দরিদ্রতাকে দূরীকরণে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসে। গ্রামীণ ব্যাংকের জামানত বিহীন সাশ্রয়ী ঋণের কারণে অনেক দরিদ্রব্যক্তির আর্থ-সামজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়েছে বলে কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক সারা বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ গ্রামে তাদের কার্যক্রমে পরিচালনা করছে। গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ক্ষুদ্রঋণদান কেন্দ্রিক একটি ব্যাংক। এর কার্যক্রম আলোচনা করা হলো:
১ । ক্ষুদ্রঋণ
গ্রামীণ ব্যাংকের মূল কার্যক্রম হলো ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা। দুঃস্থ, দরিদ্র, ভূমিহীন মানুষকে জামানতহীন ঋণদান করাই গ্রামীণ ব্যাংকের মূল কার্যক্রম। গ্রামীণ ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন পরিমাণ ঋণ সুবিধা প্রদান করে থাকে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ১০৮০.৯৬ বিলিয়ন টাকা ঋণ প্রদান করেছে এবং ব্যাংকের সদস্যদের সঞ্চয়ের পরিমাণ ১০৫.৭৯ বিলিয়ন টাকা। গ্রামীণ ব্যাংক সাধারণত চারটি শ্রেণিতে ঋণ প্রদান করে থাকে সেগুলো হচ্ছে:
ক) আয়বর্ধক কর্মকান্ডের জন্য ঋণ প্রদান
গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে । এক্ষেত্রে মৎস্য চাষ, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়, সার-বীজ ক্রয়, হাঁস-মুরগী পালন, শাকসবজি চাষ, গরু-ছাগল পালন, নার্সারি ইত্যাদি প্রকল্পের জন্য ঋণদান করে থাকে। এ ঋণদান প্রদান করা হয় বাৎসরিক ২০ শতাংশ হার সুদে। আয়বর্ধনমূলক ঋণদান কার্যক্রমের আওতায় তারা মাইকো এন্টারপ্রাইজ লোন দিয়ে থাকে। এ ঋণ প্রদানের নির্ধারিত কোনো পরিমাণ থাকে না। এখন পর্যন্ত ৬,২১০,৫৭৪ জন সদস্য এই মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ঋণ গ্রহণ করেছে। এ যাবৎ ২০৯.৪৯ বিলিয়ন টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। মাছ চাষ, পোল্ট্রি খামার সবজির দোকান, ফার্মেসী, ডেইরি, অটোরিক্সা, পাথর ব্যবসা প্রভৃতি উদ্যোগ ঋণ দেয়া হয়েছে।
খ) গৃহঋণ
বাসস্থান, খাদ্য ও বস্ত্র মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম। বাসস্থানের গুরুত্ব অনুভব করে গ্রামীণ ব্যাংক অতি দরিদ্রদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে ১৯৯৪ সালে। ‘দরিদ্রদের জন্য বাসস্থান' এই স্লোগানে কর্মসূচিটি চালু হয়েছে। সাধারণত টিনের চালা বাড়ি নির্মাণে ২৫,০০০ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়, যার সুদের পরিমান ৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে ১২.৪০ মিলিয়ন টাকা ঋন প্রদান করা হয়েছে ১,৩৯১ টি গৃহ নির্মাণে।
গ) সংগ্রামরত সদস্যদের ঋণদান
ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সবসময়ই দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির আওতার বাইরে থেকে যায়। ২০১২ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ভিক্ষাবৃত্তি দূরীভূতকরণ এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সংগ্রামরত সদস্যদের ঋণদান কর্মসূচি চালু করে । ১০৯০০০ জন্য ভিক্ষুক এখন পর্যন্ত এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশি টাকায় ১৭৩.৬৮ মিলিয়ন অর্থ ভিক্ষকদের ঋণদান করা হয়েছে যার মধ্যে ৮৪ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৯,০২৯ জন ভিক্ষুক এখন গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়মিত ঋণগ্রহণকারী সদস্য।
২। পল্লীফোন কর্মসূচি
গ্রামীণ ব্যাংকের অত্যন্ত কার্যক্রম একটি কর্মসূচি হলো পল্লীফোন কর্মসূচি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিস্তারের সাথে মানুষের বহুবিধ ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামাঞ্চলে নারীদের পল্লীফোন ক্রয় করার যাবতীয় অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ১.৪৩ মিলিয়ন গ্রাম ফোন ক্রয় বাবদ ২.১৭ বিলিয়ন টাকা গ্রামীণ মহিলাদের ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
৩ । গ্রামীণ ব্যাংক বৃত্তি
গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক বৃত্তি চালু হয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে। নারীদের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে ৫০% শতাংশ বৃত্তি নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৯৯.২৯ মিলিয়ন টাকা ২৪১,৩৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions