ইউনিসেফ কি
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের বিশ্ব কর্ণধার। এই শিশুদের উপযোগী করে বিশ্বকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার, সমষ্টি ও পরিবারকে সাহায্যে করার লক্ষেই ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর United Nation International Children's Emergency Fund (UNICEF) প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের যে সব বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শিশুকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, সেসব সংস্থার মধ্যে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (United Nations International Children's Emergency Fund-UNICEF) অন্যতম। কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন যুদ্ধাক্রান্ত দেশের শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য, বস্ত্র এবং ঔষধ সরবরাহের জন্য UNICEF প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ সালের দিকে বিশ্বের অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিসহ সার্বিক কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দানের লক্ষ্যে emergency কথাটি বাদ দিয়ে UN Children's Fund (জাতিসংঘ শিশু তহবিল) রাখা হয়। মূল নামে পরিবর্তন আনা হলেও সংক্ষিপ্ত নামটি অপরিবর্তিত থাকে। বর্তমানে ১৯০টিরও বেশি দেশে ইউনিসেফ কাজ করছে। যুদ্ধত্তোর পৃথিবীতে শিশুদেরকে জরুরি সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এর কার্যক্রম অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে পরবর্তীতে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেও কিছু পরিবর্তন এসেছে।
ইউনিসেফ'র উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ:
ক) ইউনিসেফ'র অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য হলো শিশু অধিকার রক্ষা, এ্যাডভোকেসি করা, শিশুদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে সাহায্যে করা এবং শিশুরা যাতে তাদের সক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ করতে পারে সেজন্য সুযোগ নিশ্চিত করা;
খ) শিশু অধিকার কনভেনশন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শিশু অধিকার রক্ষায় শিশুদের প্রতি আচরণের আন্তার্জাতিক মানদন্ড তৈরি করা;
গ) ইউনিসেফ জোর দিয়ে বিশ্বাস করে যে, শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নই মানুষের উন্নতির সর্বজনীন অবিচ্ছেদ্য ব্যবস্থা; ঘ) অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের জন্য প্রথম কল নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক এবং বস্তুগত সম্পদ মোবালাইজ করা এবং শিশু ও তার পরিবারকে যথাযথ সেবা দেওয়ার জন্য সক্ষমতা তৈরি ও উন্নয়নে সাহায্যে করা;
ঙ) সকল যুদ্ধ, দুর্যোগ, চরম দারিদ্র্যের শিকার, সহিংসতা ও শোষণের শিকার এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা;
চ) শিশু ও নারীদের তাদের নিজ নিজ সম্প্রাদায়ের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা; ছ. শিশুদের রোগ ও মৃত্যু প্রতিরোধ করা; এবং
চ) সকল প্রকার বৈষম্য যা শিশুর উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা দূরীভূত করা ।
ইউনিসেফ'র কার্যক্রম
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর থেকেই ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফ'র কার্যক্রম বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ইউনিসেফ'র কার্যক্রমের প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো শিশু শিক্ষা, মেয়ে শিশু ও নারীর ক্ষমতায়ন, গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি, পানি এবং পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি।
নিচে কার্যক্রমগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১। শিক্ষামূলক কার্যক্রম:
শিক্ষামূলক কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে-
ক) প্রাক-শিক্ষণঃ চার থেকে ছয় বছর বয়সি সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্যোগকবলিত শিশুদের জন্য প্রাক-শিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ইউনিসেফ প্রাক শিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম, নগরবস্তি এবং অন্যান্য অবহেলিত এলাকায় এ কর্মসূচি চালু আছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১.১ মিলিয়ন শিশুকে এ কর্মসূচির আওতায় শিক্ষাদান করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে মূলত শিক্ষার্থীদের ভাষাগত, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
খ) প্রাথমিক শিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি কার্যকর করার লক্ষ্যে ইউনিসেফ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (DPED-II) গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, সমষ্টিভিত্তিক প্রণোদনা, স্থানীয় লোকজন ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ইস্যূ নিয়ে ইউনিসেফ কাজ করছে।
গ) স্কুলের বাইরে শিশুদের জন্য শিক্ষাঃ বাংলাদেশে দারিদ্র্যের কারণে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান না। অনেক পিতামাতা সন্তানদের অল্প বয়সে বিভিন্ন প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়েজিত করেন। এজন্য ইউনিসেফ এসব কাজে নিয়োজিত শ্রমজীবী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বল্পতা আছে সেসব এলাকায় এ প্রোগ্রামের কার্যকারিতা বেশি।
ঘ) কিশোরদের জীবন দক্ষতামূলক শিক্ষাঃ বাংলাদেশে কিশোররা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মূল কারণ দারিদ্র্য মাদকাসক্ত, সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিসেস, শারিরীক ও যৌন নির্যাতন, পাচার, অব্যবহার এবং বৈষম্য। এসব কিশোরদের জীবন দক্ষতামূলক শিক্ষার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত করার জন্য ইউনিসেফ এ প্রকল্প গ্রহণ করেছে । বিশটি জেলার ২.৫ মিলিয়ন কিশোরকে সেবা দানের লক্ষ্যে এ প্রকল্প চলছে।
২। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম
বাংলাদেশের নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস ও মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নয়নে নিম্নোক্ত কার্যক্রসমূহ পরিচালিত হচ্ছে তা হলো-
ক) মাতৃত্বকালীন ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা: মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইউনিসেফ হাসাতালগুলোর সেবা বৃদ্ধি, নতুন সরঞ্জাম সরবরাহ কর্মী প্রশিক্ষণ সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ হাসপাতালগুলোর সাথে স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবকদের যোগাযোগ স্থাপন এবং মায়েদের ক্ষমতায়নে ইউনিসেফ কাজ করে ।
খ) শিশু সুরক্ষাঃ শিশুদের সকল প্রকার অসুস্থতা ও দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষার জন্য ইউনিসেফ সদা তৎপর। এজন্য ইউনিসেফ সারা বাংলাদেশে শিশুদের বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ মূলক টিকাদান কর্মসূচিতে সহায়তা করে। ২০০৪ সালে যেখানে ৭৭ শতাংশ শিশু মৌলিক টিকা ব্যবস্থার আওতায় ছিলো। এখন তা বেড়ে ৯২ শতাংশ হয়েছে। নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, পোলিও ইত্যাদি রোগের টিকাদান কর্মসূচিতে সরকারের সাথে কাজ করছে ইউনিসেফ।
গ) শিশু পুষ্টি: শিশুদেরকে অপুষ্টির হাত থেকে বাচানোর জন্য সারা বাংলাদেশে Vitamin A খাওয়ানোর ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। এ্যানোমিয়া প্রতিরোধ এবং শিশুদের ব্রেস্টফিডিং এর ব্যাপারে মায়েদের সচেতন করে ইউনিসেফ। এছাড়াও HIV/AIDS প্রতিরোধ ও এ সম্পর্কে সচেতন করে ইউনিসেফ।
৩। পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিন কর্মসূচি:
শিশু স্বাস্থ্যসহ সার্বিক জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন অপরিহার্য। ইউনিসেফ এক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় কমিউনিটি ও অন্যান্য অংশীদারের সাথে নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে ইউসিফে এক্ষেত্রেও বিভিন্নমুখি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে । এছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
৪। নগর এলাকায় মৌলিক সেবা:
নগরের বস্তি অঞ্চল হলো নগর দারিদ্র্যের বসতি। যেখানে মৌলিক সেবার অনুপস্থিতি আছে। বস্তিবাসীদের মৌলিক সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ইউনিসেফ সহযোগী অন্যান্য সংস্থাকে অনুদান দিয়ে থাকে।
৫। কমিউনিটি এ্যাভোকেসি ও অংশীদারিত্ব:
জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিসেফ। এক্ষেত্রে তারা শিশু অধিকার নিয়ে সংবাদ ও নাটক প্রচার স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা মূলক কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions