ENIAC (Electronic Numerical Integrator and Computer) ছিল বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার। এটি ১৯৪৫ সালে তৈরি করা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চালু করা হয়। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ব্যালিস্টিক গবেষণাগারের জন্য জটিল গণনা সম্পাদন করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।
ENIAC-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
- সম্পূর্ণ নাম: Electronic Numerical Integrator and Computer
- উদ্ভাবক: জন প্রেসপার একার্ট (J. Presper Eckert) এবং জন মাউচলি (John Mauchly)
- উন্নয়নের বছর: ১৯৪৩ - ১৯৪৫
- উদ্বোধন: ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬
- ব্যবহার: সামরিক ও বৈজ্ঞানিক গণনার জন্য
ENIAC-এর ইতিহাস ও নির্মাণ প্রক্রিয়া
ENIAC-এর নির্মাণ শুরু হয় ১৯৪৩ সালে, যখন মার্কিন সেনাবাহিনী দ্রুত ও নির্ভুল ব্যালিস্টিক (ক্ষেপণাস্ত্রের গতি নির্ণয়) হিসাবের জন্য একটি উন্নত গণনাযন্ত্র চেয়েছিল। সেই সময়কার বিদ্যমান যান্ত্রিক কম্পিউটারগুলো ধীরগতির ছিল এবং জটিল গণনা সম্পাদনে অক্ষম ছিল।
১৯৪৫ সালে, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জন প্রেসপার একার্ট এবং জন মাউচলির নেতৃত্বে গবেষক দল ENIAC তৈরির কাজ শেষ করে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চালু হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
ENIAC-এর প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
বৈশিষ্ট্য | বিবরণ |
---|---|
গঠন | সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার |
প্রোগ্রামিং পদ্ধতি | ম্যানুয়াল কেবল সংযোগ এবং সুইচ পরিবর্তনের মাধ্যমে |
গতি | প্রতি সেকেন্ডে ৫,০০০ সংখ্যার যোগফল নির্ণয় করতে পারত |
গাণিতিক ক্ষমতা | যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, স্কোয়ার রুট নির্ণয় করতে পারত |
ভোল্টেজ টিউব সংখ্যা | ১৭,৪৬৮টি |
ওজন | প্রায় ৩০ টন |
জায়গা | প্রায় ১,৮০০ বর্গফুট |
বিদ্যুৎ ব্যবহার | প্রায় ১৫০ কিলোওয়াট |
ENIAC-এর কাজ করার পদ্ধতি
ENIAC ছিল একটি পূর্ণ ইলেকট্রনিক কম্পিউটার যা ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করে কাজ করত। এটি একযোগে অনেক গাণিতিক গণনা করতে পারত। তবে, এটি পুনরায় প্রোগ্রামিং করা ছিল বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।
ENIAC-এর কাজের ধাপসমূহ:
- ইনপুট গ্রহণ: এটি মূলত পাঞ্চ কার্ড (Punch Card) ব্যবহার করে ইনপুট গ্রহণ করত।
- গণনা: এটি একযোগে বিভিন্ন গাণিতিক কাজ (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ) সম্পাদন করতে পারত।
- আউটপুট প্রদান: এর আউটপুট পাঞ্চ কার্ড বা প্রিন্টারের মাধ্যমে দেখা যেত।
ENIAC-এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ব্যবহার
ENIAC তৈরি হওয়ার পর এটি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রধান ব্যবহার:
- ব্যালিস্টিক ক্যালকুলেশন: মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য গোলাবারুদের গতিপথ নির্ণয়।
- পারমাণবিক গবেষণা: লস অ্যালামোস গবেষণাগারে পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য জটিল গণনা।
- আবহাওয়া পূর্বাভাস: প্রাথমিকভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।
- গাণিতিক সমস্যা সমাধান: বড় গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যবহৃত হয়।
ENIAC-এর সীমাবদ্ধতা
যদিও ENIAC ছিল বিপ্লবী, তবে এতে কিছু বড় সীমাবদ্ধতা ছিল:
- প্রোগ্রামিং জটিল ছিল: এটি পুনরায় প্রোগ্রাম করতে দীর্ঘ সময় লাগত, কারণ কেবল সংযোগ পরিবর্তন করতে হতো।
- বিশাল আকৃতি: এটি অনেক জায়গা দখল করত এবং রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন ছিল।
- উচ্চ বিদ্যুৎ খরচ: এটি অনেক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করত, যা ব্যয়বহুল ছিল।
- তাপ উৎপন্ন করত: প্রচুর ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহারের কারণে প্রচণ্ড তাপ উৎপন্ন হতো।
ENIAC থেকে আধুনিক কম্পিউটারের যাত্রা
ENIAC ছিল প্রথম ইলেকট্রনিক কম্পিউটার যা ডিজিটাল গণনার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এটি পরবর্তীকালে আধুনিক কম্পিউটারের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
- EDVAC (Electronic Discrete Variable Automatic Computer): ENIAC-এর পরবর্তী সংস্করণ, যেখানে সংরক্ষিত প্রোগ্রাম ধারণা যুক্ত করা হয়।
- UNIVAC (Universal Automatic Computer): বাণিজ্যিকভাবে তৈরি প্রথম কম্পিউটার, যা ENIAC-এর উন্নত সংস্করণ।
ENIAC-এর ওজন
ENIAC ছিল একটি বিশাল আকারের কম্পিউটার, যার মোট ওজন ছিল প্রায় ৩০ টন (৬০,০০০ পাউন্ড)! এটি এত ভারী ছিল যে এটি স্থাপনের জন্য মজবুত মেঝে এবং আলাদা কক্ষের প্রয়োজন হতো।
এত বেশি ওজন হওয়ার প্রধান কারণ ছিল এর ভেতরে ব্যবহৃত ১৭,৪৬৮টি ভ্যাকুয়াম টিউব, ৭,২০০টি ক্রিস্টাল ডায়োড, ১৫০০ রিলে, ৭০,০০০ রেজিস্টর এবং ১০,০০০ ক্যাপাসিটর। এই বিশাল পরিমাণ হার্ডওয়্যার একত্রিত করার ফলে এটি এত ভারী হয়ে গিয়েছিল।
কিছু সূত্রে ENIAC-এর ওজন ২৭ টন (৫৪,০০০ পাউন্ড) বলা হয়েছে, আবার কিছু জায়গায় ৩০ টন (৬০,০০০ পাউন্ড) উল্লেখ করা হয়।
ENIAC-এর প্রকৃত ওজন কত?
ENIAC-এর ওজন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় কারণ:
- আলাদা কম্পোনেন্ট গণনা করা হয় কি না – কিছু তথ্যসূত্র শুধু প্রধান ইউনিটের ওজন উল্লেখ করে (২৭ টন), আবার কিছু সূত্র সমস্ত আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ মোট ওজন দেয় (৩০ টন)।
- প্রাথমিক ও পরবর্তী সংস্করণের পার্থক্য – এটি নির্মাণের সময় ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের সময় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যা ওজনের তারতম্যের কারণ হতে পারে।
বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী:
- পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর সরকারি নথি অনুসারে, ENIAC-এর আনুমানিক ওজন ছিল ৩০ টনের কাছাকাছি।
- কিছু গবেষক ২৭ টন বলে উল্লেখ করেছেন, যা সম্ভবত কেবলমাত্র মূল ইউনিটের ওজন।
ENIAC ছিল কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটি প্রথম ডিজিটাল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার, যা বৈজ্ঞানিক ও সামরিক ক্ষেত্রে দ্রুত গণনা করতে পারত। যদিও এটি বর্তমান কম্পিউটারের তুলনায় অনেক ধীর, বিশাল এবং ব্যয়বহুল ছিল, তবে এটি আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি তৈরি করেছিল। ENIAC-এর উন্নয়নের মাধ্যমেই ভবিষ্যতের কম্পিউটার প্রযুক্তি বিকাশ লাভ করেছে, যা আজকের সুপারকম্পিউটার ও ব্যক্তিগত কম্পিউটার পর্যন্ত পৌঁছেছে।
প্রযুক্তি প্রেমীদের জন্য প্রশ্ন:
আপনি কি মনে করেন ENIAC-এর মতো বিশাল ও ব্যয়বহুল কম্পিউটারের যুগে বর্তমান স্মার্টফোনের প্রসেসিং ক্ষমতা কেমন পরিবর্তন এনেছে? মন্তব্য করে আপনার মতামত জানান!
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions