কম্পিউটারে RAM বাড়ানো ছাড়াও গতি বাড়ানোর কার্যকর উপায়
বর্তমান ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার ব্যবহার আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং, প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক্স ডিজাইনিং বা বিনোদন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি দ্রুতগতির কম্পিউটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক সময় আমরা দেখি যে কম্পিউটারটি ধীরগতির হয়ে পড়েছে, যেটা কাজের গতি কমিয়ে দেয় এবং বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ব্যবহারকারী মনে করেন RAM বাড়ালেই হয়তো সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু এটি একমাত্র সমাধান নয়। RAM ছাড়াও কম্পিউটারের গতি বাড়ানোর একাধিক কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে, যা আপনি নিজেই অনুসরণ করে নিতে পারেন।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করব RAM বাড়ানো ছাড়াও কীভাবে কম্পিউটারের গতি বৃদ্ধি করা যায়, যা বিশেষভাবে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর।
১. Startup প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করুন
আপনার কম্পিউটার চালু হওয়ার সাথে সাথে একাধিক সফটওয়্যার একযোগে চালু হতে পারে, যা সিস্টেমকে ধীর করে দেয়।
সমাধান:
Windows-এ Task Manager (Ctrl + Shift + Esc) খুলুন
"Startup" ট্যাবে যান
অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যারগুলিকে Disable করুন
অনেক সময় আমরা Walton, HP বা অন্যান্য স্থানীয় ব্র্যান্ডের ল্যাপটপে বিভিন্ন প্রি-ইনস্টলড অ্যাপস পাই, যেগুলোর বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয়। সেগুলো বন্ধ রাখুন।
২. হার্ডড্রাইভের পরিবর্তে SSD ব্যবহার করুন
একটি SSD (Solid State Drive) হাই স্পিড স্টোরেজ ডিভাইস, যা ট্র্যাডিশনাল HDD এর চেয়ে ৫-১০ গুণ দ্রুত কাজ করতে পারে।
উপকারিতা:
Windows Boot Time কমে যাবে
সফটওয়্যার দ্রুত ওপেন হবে
ফাইল ট্রান্সফার স্পিড বেড়ে যাবে
বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন কিছু জনপ্রিয় SSD ব্র্যান্ড:
Transcend
Kingston
Samsung
Adata
৩. ব্লোয়েটওয়্যার ও অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার রিমুভ করুন
অনেক সময় নতুন পিসি বা ল্যাপটপে বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার থাকে যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই, কিন্তু তারা RAM এবং CPU ব্যবহার করে কম্পিউটার ধীর করে ফেলে।
সমাধান:
Control Panel > Programs > Uninstall a Program-এ গিয়ে অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস আনইনস্টল করুন
CCleaner বা Revo Uninstaller ব্যবহার করে গভীরভাবে মুছতে পারেন
৪. ড্রাইভার আপডেট করুন
আপনার সিস্টেমের সমস্ত হার্ডওয়্যার উপযুক্তভাবে কাজ করার জন্য ড্রাইভার হালনাগাদ থাকা জরুরি। পুরনো ড্রাইভার পারফরম্যান্স কমিয়ে দিতে পারে।
সমাধান:
Windows Update চালু রাখুন
ডিভাইস ম্যানেজারে গিয়ে ড্রাইভার ম্যানুয়ালি আপডেট করুন
বাংলাদেশে যারা Walton বা Symphony ল্যাপটপ ব্যবহার করেন, তারা কোম্পানির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সঠিক ড্রাইভার নামাতে পারেন
৫. Temp ফাইল ও ক্যাশ পরিষ্কার করুন
সফটওয়্যার ব্যবহার করার সময় অনেক অস্থায়ী ফাইল তৈরি হয় যেগুলো পরবর্তীতে সিস্টেমকে ধীর করে দেয়।
পরিষ্কারের পদ্ধতি:
Run (Windows + R) > টাইপ করুন
%temp%
> সব ফাইল ডিলিট করুনআবার Run > টাইপ করুন
temp
> ফাইলগুলো ডিলিট করুনCCleaner ব্যবহার করে সহজেই এই কাজটি করতে পারেন
৬. Disk Defragment এবং Disk Cleanup চালান (HDD ব্যবহারকারীদের জন্য)
HDD ব্যবহারের ক্ষেত্রে Defragment করলে হার্ডড্রাইভে থাকা ফাইলগুলো সুন্দরভাবে সাজানো হয়, যার ফলে অ্যাক্সেস টাইম কমে যায়।
পদ্ধতি:
Start Menu > টাইপ করুন "Defragment and Optimize Drives"
সেখানে HDD নির্বাচন করে Optimize দিন
Start Menu > টাইপ করুন "Disk Cleanup" > ড্রাইভ নির্বাচন করে Cleanup করুন
নোট: SSD থাকলে Defragment না করাই ভালো
৭. Visual Effects হ্রাস করুন
Windows-এ কিছু চমৎকার ভিজুয়াল ইফেক্ট থাকে যা সিস্টেম রিসোর্স ব্যবহার করে। সেগুলো বন্ধ করলে গতি বাড়ে।
পদ্ধতি:
Start > System > Advanced system settings
Performance Settings-এ যান
“Adjust for best performance” সিলেক্ট করুন অথবা ম্যানুয়ালি শুধু প্রয়োজনীয় ইফেক্ট রাখুন
৮. অ্যান্টিভাইরাস এবং ম্যালওয়্যার স্ক্যান করুন
ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার থাকলে সিস্টেমের গতি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে।
সেরা অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার (ফ্রি ও প্রিমিয়াম):
Windows Defender (ডিফল্ট হিসেবে খুবই ভালো)
Avast
Bitdefender
Malwarebytes (ম্যালওয়্যার রিমুভ করতে কার্যকর)
অনেকেই ইন্টারনেট ক্যাফে বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ক্র্যাকড সফটওয়্যার ব্যবহার করেন, যেগুলোতেই ভাইরাস থাকতে পারে। তাই শুধুমাত্র বিশ্বস্ত সোর্স থেকে সফটওয়্যার ব্যবহার করুন।
৯. ব্রাউজার অপ্টিমাইজ করুন
অনেকের ব্রাউজারে একসাথে ২০-৩০টি ট্যাব খোলা থাকে, যা RAM ও CPU খায়।
সমাধান:
ব্রাউজারে অপ্রয়োজনীয় এক্সটেনশন মুছে ফেলুন
Chrome Settings > Performance > Memory Saver চালু করুন
Brave বা Opera Mini-এর মতো লাইটওয়েট ব্রাউজার ব্যবহার করুন
১০. অটো আপডেট বন্ধ রাখুন (নির্বাচিত ক্ষেত্রে)
অনেক সফটওয়্যার ব্যাকগ্রাউন্ডে আপডেট নিতে থাকে, যা নেটওয়ার্ক ও প্রসেসিং ক্ষমতা খরচ করে।
সমাধান:
Settings > Update & Security > Pause Updates
Adobe, Java, Skype-এর মতো সফটওয়্যারে অটো আপডেট বন্ধ রাখুন
সতর্কতা: Windows Security Update মাঝে মাঝে জরুরি, তাই একদম বন্ধ না রাখাই ভালো।
১১. RAM এর Page File কনফিগার করুন
Windows যখন RAM পূর্ণ হয় তখন HDD বা SSD এর একটি অংশ ব্যবহার করে, যেটিকে Page File বলা হয়। এটি সঠিকভাবে কনফিগার করলে গতি কিছুটা বাড়তে পারে।
পদ্ধতি:
System Properties > Advanced > Performance Settings > Advanced > Virtual memory
Custom size নির্বাচন করে:
Initial size = আপনার RAM এর সমান MB (যদি 4GB RAM হয় তাহলে 4096MB)
Maximum size = দ্বিগুণ
১২. সফটওয়্যার হালকা সংস্করণ ব্যবহার করুন
ভারি সফটওয়্যার ব্যবহারের পরিবর্তে হালকা সফটওয়্যার ব্যবহার করুন যেগুলোর কার্যক্ষমতা ভালো কিন্তু কম রিসোর্স খায়।
বিকল্প উদাহরণ:
Microsoft Office এর পরিবর্তে WPS Office
Adobe Photoshop এর পরিবর্তে Photopea বা GIMP
VLC Media Player এর পরিবর্তে PotPlayer
১৩. Regedit-এর মাধ্যমে অপটিমাইজ করুন (অভিজ্ঞদের জন্য)
Windows Registry অপটিমাইজ করে কিছু নির্দিষ্ট ফিচার ডিজেবল করে গতি বৃদ্ধি সম্ভব। তবে এটি সাবধানতার সঙ্গে করতে হবে।
বিশেষ সতর্কতা: ভুল Regedit পরিবর্তন করলে সিস্টেম ক্র্যাশ করতে পারে। তাই ব্যাকআপ নিয়ে কাজ করুন।
১৪. Lite Version OS ব্যবহার করুন (Low-end PC জন্য)
যদি আপনার কম্পিউটার খুবই পুরাতন হয় (Core 2 Duo, Pentium 4), তাহলে Windows 10 Lite বা Linux Mint, Zorin OS Lite ব্যবহার করতে পারেন।
প্রচলিত কিছু লাইটওয়েট অপারেটিং সিস্টেম:
Windows 10 LTSC
Linux Mint XFCE
Zorin OS Lite
১৫. BIOS/UEFI আপডেট করুন
BIOS আপডেট করলে হার্ডওয়্যার সাপোর্ট উন্নত হয় এবং মাঝে মাঝে পারফরম্যান্স বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।
সতর্কতা: ভুলভাবে BIOS আপডেট করলে পুরো মাদারবোর্ড অকেজো হয়ে যেতে পারে। তাই অফিসিয়াল গাইড অনুসরণ করুন।
১৬. সঠিক পাওয়ার সেটিংস নির্বাচন করুন
ডিফল্ট হিসেবে অনেক ল্যাপটপ "Power Saver" মোডে থাকে, যেটা পারফরম্যান্স কমিয়ে দেয়।
পদ্ধতি:
Control Panel > Power Options > "High Performance" নির্বাচন করুন
Battery > Settings > Optimize for performance নির্বাচন করুন
১৭. ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপস বন্ধ করুন
Windows-এ অনেক অ্যাপস ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকে যেগুলো RAM এবং CPU ব্যস্ত রাখে।
পদ্ধতি:
Settings > Privacy > Background apps > অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস Off করুন
কম্পিউটারের গতি বাড়াতে RAM বাড়ানো ছাড়াও বহু কার্যকর উপায় রয়েছে যা অনেক সময় আরও ভালো ফলাফল দেয়। উপরোক্ত প্রতিটি টিপস বাস্তবায়ন করলে আপনি আপনার পুরনো অথবা ধীরগতির পিসিকে নতুনের মতো দ্রুতগতির করে তুলতে পারবেন। যেখানে অনেকেই কম বাজেটের ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ ব্যবহার করেন, সেখানকার ব্যবহারকারীদের জন্য এই উপায়গুলো অত্যন্ত কার্যকর ও প্রয়োজনীয়।
স্মার্টলি কম্পিউটার ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং প্রযুক্তিকে আপনার কাজের গতি বৃদ্ধির সেরা সহকারী করে তুলুন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions