নিউরালিংক ও স্মার্ট বায়োনিক আই: ভবিষ্যতের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার পথে এক বিপ্লব
মানবদেহে প্রযুক্তির অনুপ্রবেশের দিগন্ত প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কে চিপ ইমপ্লান্ট, রোবোটিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রণ কিংবা দৃষ্টিশক্তিহীনদের চোখে আলো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন—এসব এখন আর শুধুই কল্পবিজ্ঞান নয়। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান Neuralink। সম্প্রতি Neuralink ঘোষণা দিয়েছে, তারা University of California, Santa Barbara-এর সঙ্গে যৌথভাবে এক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিচ্ছে, যার লক্ষ্য ‘Smart Bionic Eye’ তৈরি করা।
এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করব এই গবেষণা কী, কেন এটি যুগান্তকারী, নিউরালিংক কীভাবে যুক্ত হয়েছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এবং এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানুষের জীবন কতটা পরিবর্তিত হতে পারে।
নিউরালিংক কী এবং এটি কী করে?
Neuralink Corporation ২০১৬ সালে এলন মাস্কের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান মূলত ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস (BMI) বা ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) নিয়ে কাজ করছে। উদ্দেশ্য হলো মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রকে সরাসরি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত করে মানুষের জ্ঞান, অনুভূতি, কিংবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করা।
Neuralink ইতিমধ্যে এমন একটি ইমপ্লান্ট তৈরি করেছে, যা বানরের মস্তিষ্কে স্থাপন করে তাকে ভিডিও গেম খেলার ক্ষমতা দিয়েছে শুধুমাত্র চিন্তা করে। এমনকি ২০২৪ সালের শুরুতে প্রথম মানব রোগীর ওপর সফলভাবে চিপ ইমপ্লান্ট করে তারা টেলিপ্যাথি এবং কেবল চিন্তার মাধ্যমে পিসি ব্যবহারের সক্ষমতা দেখিয়েছে।
বায়োনিক আই বা স্মার্ট চোখ কী?
বায়োনিক আই বলতে এমন একটি ডিভাইসকে বোঝানো হয়, যা মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করে, বিশেষত যাদের চোখ অন্ধ বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এই প্রযুক্তির মূল কাজ হলো বাইরের দৃশ্য ধরা, সেটিকে ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তর করা এবং সরাসরি মস্তিষ্ক বা রেটিনায় প্রেরণ করা, যেন মস্তিষ্ক সেই চিত্র বুঝতে পারে।
Neuralink-এর উদ্যোগটি এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিচ্ছে। তারা শুধু চোখ নয়, বরং পুরোপুরি ব্রেইন-ভিত্তিক ভিশন সিস্টেম তৈরি করতে চায়। এটি একটি “AI-powered visual prosthetic” – যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চিপ-ভিত্তিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করবে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পেছনের গবেষণা এবং অংশীদার প্রতিষ্ঠান
এই গবেষণার মূল আয়োজক University of California, Santa Barbara (UCSB)। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে স্পেনের কিছু রিসার্চ টিম এবং নিউরালিংক। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি ClinicalTrials.gov এ জুলাই ২০২৫-এর শেষে রেজিস্টার করা হয়।
মূল উদ্দেশ্য হলো এমন একটি সিস্টেম তৈরি করা যা অন্ধ বা আংশিকভাবে দৃষ্টিহীন রোগীদের—
-
মুখ শনাক্ত করতে সাহায্য করবে,
-
দিকনির্দেশনা বুঝতে সাহায্য করবে,
-
চলাফেরা করতে সাহায্য করবে,
-
বই/লেখা পড়তে সক্ষম করে তুলবে।
Neuralink এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টেকনোলজিকাল সহযোগী হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যারা ব্রেইন-চিপ ইমপ্লান্ট সরবরাহ করবে এবং সেগুলো পরীক্ষা করার জন্য ভবিষ্যতের রোগীদের প্রস্তুত রাখবে।
Blindsight প্রযুক্তি ও AI Vision Interface
Neuralink যেই ডিভাইস নিয়ে কাজ করছে সেটির নাম “Blindsight”। এটি হচ্ছে একটি ব্রেইন-ইমপ্লান্ট, যা বিশেষভাবে ভিজ্যুয়াল সিগনালগুলো মস্তিষ্কে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে যুক্ত রয়েছে—
-
সেন্সর ক্যামেরা যা বাইরের ছবি সংগ্রহ করবে,
-
AI সিস্টেম যেটি চিত্র বিশ্লেষণ করে সংকেত তৈরি করবে,
-
ইলেকট্রোডসমূহ যা মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সে সেই সংকেত পৌঁছে দেবে।
মূল কথা, চোখ বা রেটিনা ছাড়াই শুধু ক্যামেরা ও মস্তিষ্কের মধ্যে একটি ডাইরেক্ট লিংক তৈরি করে রোগী দৃশ্য বুঝতে পারবে।
Neuralink বলছে, এই প্রযুক্তি সফলভাবে কার্যকর করা গেলে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার পর্যন্ত রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে ২০৩১ সালের মধ্যে।
এখন পর্যন্ত অগ্রগতি
Neuralink এখন পর্যন্ত বানরের ওপর Blindsight চিপ ব্যবহার করেছে। এখনও কোনো মানুষ এই ডিভাইস ব্যবহার করেনি। তবে ২০২৪ সালে তারা প্রথম মানব ব্রেইন-চিপ ইমপ্লান্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছে, যা “টেলিপ্যাথি” নামে পরিচিত ছিল।
UCSB-এর নেতৃত্বে চলা এই নতুন গবেষণায় Neuralink-এর রোগীদের ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যেই প্রথম বায়োনিক আই চিপ মানুষের শরীরে স্থাপন করা।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি
এই প্রযুক্তি যদি সফল হয় তাহলে—
-
জন্মগতভাবে অন্ধ ব্যক্তিরাও দেখতে পাবেন,
-
যাদের রেটিনায় সমস্যা রয়েছে তারাও নতুন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারেন,
-
শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য AI-ভিত্তিক চলাফেরা ও নেভিগেশন সহজ হবে,
-
যুদ্ধাহত বা দুর্ঘটনায় দৃষ্টিহীনতা হওয়া রোগীদের জীবনে পুনরায় আলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এমনকি ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সুস্থ মানুষের চোখে আরও উন্নত "AI Vision" যোগ করা যেতে পারে—যেমন রাতেও স্পষ্ট দেখা, জুম সুবিধা, কিংবা তাপমাত্রা শনাক্তকরণ।
সম্ভাব্য ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
যদিও এই প্রযুক্তি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, তবে এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিও রয়েছে:
-
মানবদেহে ইমপ্লান্ট করা সবসময় একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ,
-
স্নায়ুতন্ত্রে সরাসরি সংযোগ করার ফলে দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কে কী প্রভাব পড়বে তা এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি,
-
নৈতিক ও সামাজিক বিতর্ক রয়েছে—মানুষের মস্তিষ্কে AI যুক্ত করা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে,
-
সাইবার সিকিউরিটির ঝুঁকি, যেহেতু মস্তিষ্ক সরাসরি প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত।
Neuralink অবশ্য এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক ও আইনগত কাঠামো তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা
Neuralink এই ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের প্রতিযোগী হিসেবে কাজ করছে—
-
Synchron (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক, FDA অনুমোদন পেয়েছে)
-
Paradromics (brain-computer interface এর জন্য পরিচিত)
-
EyeTech Digital Systems (ভিশন ট্র্যাকিং ও অ্যাসিস্টিভ টেকনোলজি নির্মাতা)
তবে Neuralink-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তারা ইতিমধ্যেই সফলভাবে মস্তিষ্কে চিপ বসিয়েছে এবং প্রভাবশালী বিনিয়োগ ও জনপ্রিয়তা রয়েছে এলন মাস্কের কারণে।
জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া ও বৈজ্ঞানিক মহলের মতামত
Neuralink-এর এই উদ্যোগ জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কেউ কেউ একে ভবিষ্যতের আলো হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে একে মানুষের ওপর প্রযুক্তির আধিপত্য বলে আশঙ্কা করছেন।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে দুটি প্রধান মত রয়েছে—
-
একদল বলছেন, এটি ভবিষ্যতের চিকিৎসার একটি বৈপ্লবিক রূপান্তর এবং অন্ধত্ব দূরীকরণের একটি বাস্তব সমাধান।
-
অন্যদল বলছেন, যখন মস্তিষ্কে চিপ বসানো হয়, তখন তা ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং সত্তার প্রশ্ন তোলে।
তবে একটি বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত—Neuralink ও UCSB-এর এই বায়োনিক আই গবেষণা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে চলেছে।
Neuralink-এর সঙ্গে UCSB ও স্পেনের গবেষক দল যে যৌথ উদ্যোগে স্মার্ট বায়োনিক আই তৈরির জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে, তা নিঃসন্দেহে মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং মানবতার একটি জয়। আমরা যারা এই যুগে বাস করছি, তারা হয়তোই সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী হব, যখন একজন জন্মগতভাবে অন্ধ শিশু প্রথমবারের মতো তার মায়ের মুখ দেখতে পাবে শুধুমাত্র এক টুকরো চিপের মাধ্যমে।
0মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions