বাক্য কাকে বলে
বাক্যের বিভিন্ন দিক যেমন, বাক্যের গঠন, বাক্যের উপাদান, বাক্যের শ্রেণী বিভাগ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত প্রচলিত ব্যাকরণেই হয়েছিল। একটি ভাষা অসংখ্য বাক্যের সমষ্টি। বাক্যগুলো গঠিত হয় শব্দের দ্বারা। বিচ্ছিন্ন বা এলোমেলো শব্দের দ্বারা বাক্য গঠিত হয় না। শব্দগুলোর থাকতে হয় অর্থ এবং একটি শব্দের সাথে অন্য শব্দের থাকতে হয় সম্পর্ক, তবেই বাক্য গঠিত হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো, শব্দ যখন বাক্যে বসে, তখন তাকে পদ বলা হয়। তাহলে পূর্ণ অর্থজ্ঞাপক অন্বয়যুক্ত বা সম্পর্কযুক্ত পদসমষ্টির নাম বাক্য।
সুতরাং বলা যায় যে, যে পদ সমষ্টির দ্বারা মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় তাকে বাক্য বলে।
বাক্যের গঠন
প্রচলিত ব্যাকরণে বাক্যকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়: উদ্দেশ্য (Subject) ও বিধেয় (Predicate)। যার সম্বন্ধে কিছু বলা হয় তাকে উদ্দেশ্য এবং যা বলা হয় তা বিধেয়। যেমন: শিমু বাড়ি যায়-এই বাক্যে ‘শিমু’ উদ্দেশ্য এবং ‘বাড়ি যায়’ বিধেয়। উদ্দেশ্য অংশে একটি বিশেষ্য কিংবা সর্বনাম কিংবা নামপদস্থানীয় কিছু থাকে। বিধেয় অংশে অবশ্যই একটি ক্রিয়াপদ থাকে। কোন কোন বাক্যে ক্রিয়া পদ ঊহ্য থাকতে পারে। যেমন, শিমু ভালো মেয়ে। - এই বাক্যে ‘হয়’ ক্রিয়া পদটি ঊহ্য আছে।
বাক্যের শ্রেণীবিভাগ
প্রচলিত ব্যাকরণে গঠনগত দিক থেকে বাক্যকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়: ১. সরল বাক্য (Simple Sentence), ২. মিশ্র বা জটিল বাক্য (Complex Sentence) ও ৩. যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য (Compound Sentence)।
১. সরল বাক্য : যে বাক্যে একটি মাত্র উদ্দেশ্য এবং একটি মাত্র বিধেয় থাকে তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন : ছাত্রীরা পড়ে, বৃষ্টি পড়ে। সরল বাক্যে একের অধিক উদ্দেশ্য-পদ থাকতে পারে কিন্তু বিধেয়-পদ একটি থাকে। যদি একটি সমাপিকা-ক্রিয়ার একাধিক কর্তা থাকে তাহলে সবকটি কর্তা মিলিয়ে একটি মাত্র উদ্দেশ্যরূপে গণ্য করা হয়। যেমন, ‘ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী ও অশ্বপৃষ্ঠে ইংরাজ পুরুষগণ বায়ু সেবনে বাহির হইয়াছেন’। (- রবীন্দ্রনাথ)
২. মিশ্র বা জটিল বাক্য: যে বাক্যে একটি প্রধান উপবাক্য থাকে এবং এক বা একাধিক অপ্রধান বা আশ্রিত উপবাক্য থাকে তাকে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে। যেমন, ছাত্রটি যদি পড়ে তাহলেই সে পাস করবে। এখানে ছাত্রের পাস করাই বক্তার মূল বক্তব্য। সুতরাং ‘সে পাস করবে’ হলো প্রধান বাক্য, আর ‘যদি ছাত্রটি পড়ে’ হচ্ছে পাস করার শর্ত, এটি হচ্ছে অপ্রধান বাক্য। জটিল বাক্যের অন্তর্গত প্রধান ও অপ্রধান দুটি বাক্যকেই খন্ডবাক্য বা উপবাক্য (Clause) বলা হয়। খন্ডবাক্য বা উপবাক্য দুরকমের: প্রধান বা স্বাধীন উপবাক্য (Main or Principal clause) এবং অপ্রধান উপবাক্য বা আশ্রিত উপবাক্য (Dependent clause)।
যেমন: ‘যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালবাসতেন তিনি পথের পাঁচালী লিখতে পেরেছেন।’ এই বাক্যে ‘যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালবাসতেন’, হলো আশ্রিত বা অধীন উপবাক্য (Dependent clause), আর ‘তিনি পথের পাঁচালি লিখতে পেরেছেন’; হলো প্রধান উপবাক্য (Main clause), আর ‘প্রকৃতি-প্রেমিক বিভূতিভূষণ’ হলো একটা পদগুচ্ছ। উপবাক্য বাক্যের সমগ্র অংশ হলেও তাতে একটি উদ্দেশ্য (কর্তা) ও একটি বিধেয় (একটি ক্রিয়া) অবশ্যই থাকে। কিন্তু পদগুচ্ছের এ রকম উদ্দেশ্য ও বিধেয় সব সময় থাকে না।
৩. যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য: যে বাক্য একের অধিক প্রধান উপবাক্য সংযুক্ত হয়ে গঠিত হয় তাকে যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য বলে। একের বেশি সরল বা মিশ্রবাক্যকে সংযোজক অব্যয় (‘এবং’, ‘ও’, ‘আর’ প্রভৃতি) বা বিয়োজক অব্যয় (‘অথবা, বা, কিংবা, প্রভৃতি) দিয়ে যুক্ত করে যে বাক্য গঠিত হয়, তাকে যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য বলে। যেমন: শিমু রাতের গাড়িতে আসবে এবং এখানেই থাকবে। সে না আসলে তুমি যাবে না কিন্তু সে বলেছে যে তার আসতে দেরী হবে।
শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ বাক্য গঠনের শর্ত
আলংকারিক বিশ্বনাথ বলেছিলেন, বাক্য হলো যোগ্যতা, আকাঙক্ষা ও আসত্তি যুক্ত পদ-সমুচ্চয় (‘বাক্যং সাৎ যোগ্যতা- আকাঙক্ষা-আসত্তিযুক্তঃ পদোচ্চয়ঃ)।’ বিশ্বনাথের সূত্রটি প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণে একটি মূলসূত্ররূপে গৃহীত হয়েছে। প্রথাগত ব্যাকরণবিদরা শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ বাক্য গঠনের জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করেছেন। এগুলো হলো: (১) আকাঙক্ষা (Expectancy) (২) যোগ্যতা (Compatibility) (৩) আসত্তি বা নৈকট্য (Proximity)।
১. আকাঙক্ষা: বাক্যের পদগুলি যদি বাক্যটি বিষয়ে বক্তা বা শ্রোতার চাহিদা অথবা কৌতূহল সম্পূর্ণ মেটাতে পারে, তাহলে পদগুলিকে পূর্ণাকাঙক্ষা পদ বলা হয়। যেমন: ‘আমি গিয়ে দেখলাম’ বললে শ্রোতার মনে ‘কী দেখলাম’ তা জানার আকাঙক্ষা থেকে যায়। শ্রোতার এই না মেটা কৌতূহলকেই আকাঙক্ষা বলা হয়। আবার, ‘আমি গিয়ে দেখলাম যে তার সব কাজ করা হয়ে গেছে’- এই বাক্যে আকাঙক্ষা সবটাই মিটে গেছে এবং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য হয়েছে।
২. যোগ্যতা: যে পদসমষ্টি সংগত ও অর্থবহ বাক্য গঠনের উপযোগী, তাদের যোগ্যতা আছে বলে ধরা হয়। যেমন, ‘গরুগুলো উড়ছে’, ‘কুকুরগুলো ঘাস খাচ্ছে।’ - এই দুটো বাক্যে, গরুর উড়বার যোগ্যতা নেই এবং কুকুর ঘাস খেতে অভ্যস্ত নয়। সুতরাং, এগুলো বাক্য নয়। কারণ এদের মধ্যে অর্থসংগতি নেই।
সংজ্ঞা: বাক্যের অর্থ অর্থাৎ বক্তার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার বা বৃহত্তর কিংবা গভীরতর সত্যের যে সংগতি থাকে, তাকে যোগ্যতা বলা হয়।
৩. আসত্তি বা নৈকট্য : আসত্তি বলতে বোঝায় বাক্যের অন্তর্গত পদগুলির মধ্যে সংগতি ও বিন্যাসের নৈকট্য বা ক্রম। যেমন: ‘আমি ঢাকা যাই’ বাক্যে ‘আমি’ কথাটি উত্তম পুরুষের বলে ‘যাই’ ক্রিয়াটিও উত্তম পুরুষের হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি বলি ‘আমি ঢাকা যান’ তাহলে উত্তম পুরুষের কর্তার সঙ্গে প্রথম পুরুষের ক্রিয়ার সংগতি থাকে না।
সংজ্ঞা: বাক্যের পদগুলিকে ঠিকঠিক জায়গায় সন্নিবিষ্ট করার নামকে আসত্তি বা নৈকট্য বলা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions