কবিতা কাকে বলে
সহজেই অনুমান করা যায় কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি। বাইরের জগতের রূপ-রস, স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা, অনুভূতি কল্পনাকে যিনি অনুভূতিস্নিগ্ধ ছন্দোময় শিল্পরূপ দিতে পারেন তিনিই কবি। বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে কোনো একটি সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায় তখনই জনম হয় কবিতার। বস্তুত মানব মনের ভাবনা কল্পনা যখন অনুভূতির রঙে রঞ্জিত হয়ে যথাযথ শব্দসম্ভারে বাস্তব, সুষমামন্ডিত, চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় রূপ লাভ করে তখনই তা হয়ে ওঠে কবিতা।
ছন্দোবদ্ধ পদকেই কবিতা বলা যায়। ছন্দই কবিতার প্রাণ, ছন্দই কবিতাকে তার স্বরূপগত বৈশিষ্ট্যে উন্নীত হতে সাহায্য করে। কিন্তু কেবল ছনদই কবিতার সব ও শেষ কথা নয়। কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ তার অলংকার। কবিতার মধ্যে কবির কল্পনাশক্তির প্রকাশ, অনুভূতির উচ্ছ্বাস বাণীমূর্তিতে ধরা পড়ে। চর্যাপদ বাংলা কাব্য সাহিত্যের আদি নিদর্শন। এর কবিতাগুলোতে শুধু ধর্মের কথাই নয়, আছে ভালো কবিতার স্বাদ; আছে সেকালের বাংলার সমাজছবি। ছবিগুলো এতো জীবন্ত যে, মনে হয় ‘এই মাত্র প্রাচীন বাংলার গাছপালা, আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটু হেঁটে এলাম।’ চর্যাপদে আছে অসহায় মানুষের বেদনার কথা; রয়েছে সুখের উল্লাস। আছে চমৎকার ছন্দোবদ্ধ পদ এবং অলংকারের ব্যবহার।
কবিতার সংজ্ঞায় ST Coleridge বলেন, Best words in best order. অর্থাৎ অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসকে কবিতা বলা যায়। নানাভাবে মনের ভাব-কল্পনা যখন অনুভূতিরঞ্জিত, যথাবিহীত শব্দসম্ভারে বাস্তব সুষমামন্ডিত ছন্দময়রূপ লাভ করে তখন তা কবিতা হয়ে ওঠে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings. অর্থাৎ কবিতা দুর্নিবার আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। Shelly এর মতে- Poetry is the general sense may be defined as the expression of the imagination. কল্পনাকে প্রকাশ করার নামই কবিতা। সাধারণভাবে কবিতা বলতে ছন্দোবন্ধ পদকে বুঝি। আর বৃহৎ অর্থে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘নিজের প্রাণের মধ্যে, পরের প্রাণের মধ্যে ও প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিবার ক্ষমতাকেই বলি কবিত্ব।’
কবিতার প্রকারভেদ
কবিতাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- মন্ময় কবিতা এবং তন্ময় কবিতা
মন্ময় কবিতা
অলংকার শাস্ত্রে কবিকে প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রজাপতি ব্রহ্মা যেমন বিশ্বজগৎকে আপন কল্পনা দিয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি কবিগণ শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে এক বিচিত্র মায়ার জগৎ সৃষ্টি করেন। কবি যখন একামত্ম ব্যক্তিগত অনুভূতি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাবনা, চিন্তা তার কাব্যে সামগ্রিক রূপে গ্রহণ করে আত্মপ্রকাশ করেন তখন সেই অমর সৃষ্টিকে মন্ময় কবিতা বলে। মন্ময় কবিতা ব্যক্তিনিষ্ঠ। কবির অমত্মরের অনুভূতির দিকগুলো মন্ময় কবিতায় ধরা পড়ে। কাব্যতত্তব, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা এবং রস সৌন্দর্যের বিচারে মনময় কবিতাই শ্রেষ্ঠ। মনময় কবিতা প্রধানত দুই প্রকার। যথা- গীতি কবিতা ও সনেট।
তন্ময় কবিতা
আধুনিক গীতি কবিতার অন্যতম কবিতারূপ তন্ময় কবিতা। জগৎ-সংসার বা বস্তুবিশ্বের কোনো বিষয় যখন কবি হৃদয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে কবির অনুভূতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে তখনই বিষয়গত গীতিকবিতার সৃষ্টি। তন্ময় কবিতায় বস্তুসত্তাই প্রধান। আলংকারিক ভাষার নৈপুণ্য, ছন্দের জাদুকরী বৈচিত্র্য, ভাবের ব্যঞ্জনা ও কল্পনার চমৎকারিতবই হলো তন্ময় কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এর প্রধান দুটো ধারা হলো মহাকাব্য ও গদ্য কবিতা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions