উপন্যাস কাকে বলে
উপন্যাস বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যে আধুনিক কালের সৃষ্টি, বর্তমানে এটি সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় মাধ্যম। বাংলা সাহিত্যের আদি ও মধ্যযুগে রচিত রূপকথা, নাথ-সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, গীতিকা-সাহিত্য প্রভৃতির কাব্যরূপের মধ্যেও গল্পধর্মী উপকরণ পাওয়া যায়। এগুলোতে কেবল গল্পরস নয়; সরস পরিবেশন ভঙ্গিটিও লক্ষ্যণীয়। উপন্যাস রচনার জন্য প্রয়োজন যে নিপুণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রত্যয়, ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও গভীর সহানুভূতি, তা মধ্যযুগের কোনো কোনো কবির কাব্যে বিশেষত কবি কঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রাচ্যে প্রথম প্রকৃত উপন্যাসের শিল্পগুণ ও লক্ষণ লক্ষ্য করা গেছে প্রায় এক হাজার বছর আগে রচিত মুরাসাকি শিকিবা নামে এক জাপানী লেখিকার ‘গেন্জির কাহিনী’ The tale of Genji রচনাটিতে। চতুর্দশ শতকে ইতালীয় লেখক বোকাচিওর হাতে প্রথম উপন্যাসধর্মী রচনার সৃষ্টি হয়। উপন্যাস পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রতিচ্ছবি। অন্যান্য শিল্পকর্মের তুলনায় উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য এই যে, পাঠক এখানে জীবনকে বাস্তব রূপে দেখতে চায়; জীবনের গতি-প্রকৃতিকে অনুধাবন করতে চায়। কিন্তু জীবনকে কোনো বাঁধাধরা সংজ্ঞার্থে ধারণ করা যায় না বলে উপন্যাসে কোন ধরনের জীবনকে ঠিক কীভাবে অনুধাবন করা যাবে, তা সঠিক বলা যায় না। তবে মোটামুটি দীর্ঘ যে কল্পিত গদ্য-কাহিনীতে জীবনের জটিলতা সত্ত্বেও রক্ষিত হয় একটি শিল্পগত ঐক্য- তাকে উপন্যাস বলা যায়।
উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছেন। Fielding লিখেছেন, Novel is a cosmic epic in prose.’ Prof. Warren লিখেছেন, A Novel is a fictitious narrative which Contains a plot. সহজভাবে বলা যায়, লেখকের ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন ও জীবনানুভূতি কোনো বাস্তব কাহিনীকে অবলম্বন করে যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয়, তাকে উপন্যাস বলে। নাটকে রঙ্গমঞ্চ ও দৃশ্যাবলি যে কাজ করে, ঔপন্যাসিক বর্ণনার সাহায্যে সেই কাজটি সম্পন্ন করেন। এর ঘটনাবলি কয়েকটি চরিত্রকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, উপন্যাসে ঘটনাই মুখ্য, চরিত্রসৃষ্টি গৌণ। আমাদের বিচারে, ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়- একটি অপরটির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। চরিত্রই নিজের চারিদিকে ঘটনার জাল বুনে ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টি করে এবং ঘটনা চরিত্রসৃষ্টির সাহায্য করে। চরিত্রকে ফোটাবার জন্য প্লটের দরকার, সেজন্য পারিপার্শিবক অবস্থানে যোগ করতে হয়। তখন চরিত্র ও ঘটনাবলি বিন্যাসের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। পাত্রপাত্রীগণের কথোপকথন উপন্যাসে বিশেষ প্রয়োজনীয়। সাবলীল, সহজ ও স্বাভাবিক সংলাপ উপন্যাসের চরিত্রবিকাশে সহায়ক। এছাড়া যে-দেশের, যে-কালের, যে-সমাজের উপন্যাস লেখা হয়, সেই দেশ-কাল-সমাজের রুচি, আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতি অনুযায়ী রচিত হয়ে থাকে উপন্যাস। এতে কোনো বিষয়ের অযথা দীর্ঘ বর্ণনা শোভন নয়। কোনো কোনো ঔপন্যাসিক বিশেষ কোনো স্থান বা জেলার অধিবাসীদের আচার ব্যবহার বা জীবনযাত্রার আখ্যান নিয়ে উপন্যাস রচনা করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions