কপোতাক্ষ নদ কবিতা
ভুমিকা:
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামক সনেট কাব্য থেকে ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছে। এ কবিতায় কবির শৈশবে দেখা কপোতাক্ষ নদের প্রতি ভালোবাসার অন্তরালে স্বদেশপ্রেমের বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। সাময়িক মোহে পাশ্চাত্য সাহিত্যে আত্মপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে প্রবাস জীবনে স্বদেশের প্রতি অনুরাগের স্বরূপ তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বর্ণনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কবির আকূল আকুতি কপোতাক্ষ নদ যেন তাঁর স্বদেশের প্রতি হৃদয়ের কাতরতা বঙ্গবাসীর নিকট ব্যক্ত করে।
কবিতা:
কপোতাক্ষ নদ
-মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে !
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে !
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-সত্মনে।
আর কি হে হবে দেখা? - যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে।
কবিতার সারসংক্ষেপ:
বিদেশে বসে দেশের নদী কপোতাক্ষের কথা কবির মনে পড়ে। বহু দেশের বিচিত্র নদী কবি দেখেছেন। কিন্তু ওই নদীর তুলনা আর কোথাও পাননি। তাঁর কাছে এ নদী মায়ের দুধের মতো তৃপ্তিদায়ক। কবির আশঙ্কা, তাঁর সাথে কপোতাক্ষের আর দেখা নাও হতে পারে। কবির আকুতি : বিদেশে বসেও কবি যে দেশের নদীরই গান গাইছেন, কপোতাক্ষ যেন বাংলার মানুষকে সে কথাটা জানায়।
নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :
কর- খাজনা; রাজস্ব। কলকলে- নদীর কলকল আওয়াজে। নিশা- রাত্রি; রাত। বঙ্গজ জন- বঙ্গে জনেমছেন যিনি, বাঙালি। বঙ্গের সঙ্গীতে- বাংলার গানে। বারি- পানি। বারি-রূপ কর- জল রূপ খাজনা, প্রজা যেমন রাজাকে কর বা রাজস্ব দেয় তেমনি কপোতাক্ষ নদও সাগরকে জলরূপ কর বা রাজস্ব দিচ্ছে। বিরলে- একামত্ম নিরিবিলিতে। ভ্রামিত্ম- ভুল। ভ্রামিত্মর ছলনে- ভুলের ছলনায়। মিনতি- প্রার্থনা। যেমতি- যেমন। সখা-রীতে- বন্ধুর রীতিতে; বন্ধুর নিয়মে। সতত- সর্বদা; সবসময়।
চতুর্দশপদী কবিতা- ইংরেজিতে Sonnet, বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা। গীতিকবিতার যে রূপটি চৌদ্দ চরণ এবং চৌদ্দ মাত্রার সমন্বয়ে গঠিত হয় তাকে চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট বলে। চতুর্দশপদী কবিতার প্রথম আট চরণের সত্মবককে অষ্টক (Octave) এবং পরবর্তী ছয় চরণের সত্মবককে ষষ্টক (Sestet) বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি থাকে। চতুর্দশপদী কবিতায় কয়েক প্রকার অন্ত্যমিল প্রচলিত আছে। যেমন, প্রথম আট চরণ : কখখক কখখক। শেষ ছয় চরণ : ঘঙচ ঘঙচ। অথবা প্রথম আট চরণ : কখখগ কখখগ, শেষ ছয় চরণ : ঘঙঘঙ চচ। ‘কপোতাক্ষ নদ’ একটি চতুর্দশপদী কবিতা। এখানে মিলবিন্যাস : কখকখকখখক গঘগঘগঘ।
কবি পরিচিতি:
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত এবং মাতা জাহ্নবী দেবী। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরম্ন হয় সাগরদাঁড়ির গ্রামের পাঠশালায়। শৈশবেই তিনি ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অতঃপর তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি ডিরোজিও প্রভাবিত ইয়ং-বেঙ্গল দল দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। বাল্যকাল থেকেই মধুসূদন ইংরেজি কবিতার প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বিলেতে গিয়ে তিনি বড় কবি হবেন এ-ই ছিল তাঁর বাল্যের স্বপ্ন। এ উদ্দেশ্যেই ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর নামের প্রথমে যোগ হয় ‘মাইকেল’। ১৮৬২ সালে মধুসূদন ইউরোপ যান। তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পাস করেন। লন্ডন থেকে তিনি ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে যান ও বেশ কয়েক বছর অবস্থান করেন। প্রথমে ইংরেজি ভাষায় কবিতা রচনা আরম্ভ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে রেখে যান অক্ষয় অবদান। বিষয় ভাবনা, জীবনার্থ এবং প্রকরণ-শৈলীর স্বাতন্ত্র্যে মধুসূদনের রচনা আধুনিকতার শিখরস্পর্শী। অমিত্রাক্ষর ছন্দরীতির আবিষ্কার ও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা তাঁর অমর কীর্তি। মহাকাব্য, সনেট, পত্রকাব্য, প্রহসন, ট্র্যাজেডি নাটক ইত্যাদি সাহিত্যশাখা বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম প্রবর্তন করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন কলকাতার আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা :
কাব্যগ্রন্থ : তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী;
নাটক : পদ্মাবতী, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী;
প্রহসন : একেই কি বলে সভ্যতা?, বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ;
গদ্য-কাব্য : হেকটর-বধ (অসমাপ্ত)।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions