প্রাণ কবিতা
ভূমিকা:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাণ’ কবিতাটি ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। এই কবিতায় স্বীয় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগের মাধ্যমেই অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। আর মানুষের মাঝে চিরস্মরণীয় থাকার জন্য প্রয়োজন মহৎ সৃষ্টির দৃঢ় সংকল্প।
কবিতা:
প্রাণ
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই !
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময় -
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয় !
তা যদি না পারি, তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
হাসি মুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়॥
কবিতার সারসংক্ষেপ:
দুনিয়াটা সুন্দর। এই সুন্দর ছেড়ে কবি মরতে চান না। তিনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চান। মানুষের জীবন হাসিকান্নায় ভরপুর। কবি তাঁর কাব্যে জীবনের এই বৈচিত্র্যকে অমর রূপ দিয়ে মানুষের চিরন্তন ভালোবাসা পেতে চান। অমর কাব্য না লিখতে পারলেও ক্ষতি নেই। যতদিন তাঁর কাব্যের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে, ততদিন যেন মানুষ সেগুলো গ্রহণ করে- এই কবির একান্ত চাওয়া।
নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :
অমর আলয়- অমর সৃষ্টি অর্থে। কানন- বাগান। চিরতরঙ্গিত- সর্বদা কল্লোলিত; বহমান। জীবন্ত হৃদয় মাঝে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমসত্ম সৃষ্টিতে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আকাঙক্ষা প্রকাশ করেছেন। আলোচ্য অংশে তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঠাঁই- ঠিকানা; স্থান। নব নব সঙ্গীতের কুসুম ফুটাই- রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির জগৎ বিপুল; মানুষের জীবনের বিচিত্র অনুভব-অনুভূতি, ভাব-ভাবনা ও কর্মের জগৎকে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রাণময় করে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর সেই সৃষ্টির মধ্য থেকে রূপ-রস-গন্ধ যেন মানুষ অনুভব করতে পারে তার জন্য তিনি প্রতিনিয়ত ফুটিয়ে তুলছেন সৃষ্টির কুসুম। বিরহমিলন কত হাসি-অশ্রম্নময়- মানুষের জীবন কুসুমাসত্মীর্ণ নয়। হাসি-কান্না; আনন্দ-বেদনা নিয়ে তার জীবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানব জীবনের এই বৈচিত্র্যের মধ্যে স্থান করে নিতে চেয়েছেন। আর তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বিপুল এক আখ্যান। ভুবনে- পৃথিবীতে; ধরায়। লভি- লাভ করি। সূর্য করে- সূর্যের আলোতে।
কবি পরিচিতি:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হলেও বিদ্যালয়ের পড়ালেখার প্রতি তিনি মনোযোগী ছিলেন না। ফলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ঠাকুর বাড়ির অনুকূল পরিবেশে শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। ১৮৭৬ সালে পনের বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বনফুল’। অতঃপর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য, রম্যরচনা, সঙ্গীত ইত্যাদি শাখায় রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন তাঁর অসামান্য শিল্পপ্রতিভার স্বাক্ষর। ১৯০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়।’ এ বিদ্যালয়ই পরবর্তীকালে ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপলাভ করে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’(১৯১১) কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে প্রথম কৃষিব্যাংক স্থাপন করেন। বাংলাদেশের শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুরে জমিদারির তত্ত্বাবধান-সূত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত করেন। বাংলা কবিতাকে তিনিই প্রথম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রসারিত করেন। বাংলা ছোটগল্পকে তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। গীতিকার ও চিত্রশিল্পী হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের অবদান অনন্যসাধারণ। তিনি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) কলকাতায় পরলোকগমন করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা :
কবিতা : মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, গীতাঞ্জলি, বলাকা, শেষলেখা;
উপন্যাস : চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা;
ছোটগল্প : গল্পগুচ্ছ, তিনসঙ্গী, গল্পসল্প;
নাটক : বিসর্জন, রাজা, অচলায়তন, ডাকঘর, রক্তকরবী;
প্রবন্ধ : আধুনিক সাহিত্য, মানুষের ধর্ম, কালান্তর, সাহিত্যের স্বরূপ;
আত্মজীবনী : জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions