পেঁয়াজের এবং রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা
পেঁয়াজের উপকারিতা ও অপকারিতা
বলা হয় দুনিয়াটা দুই রকমের গোষ্ঠীতে বিভক্ত—এক, যারা পেঁয়াজ রসুন পছন্দ করে, দুই, যারা এদেরকে ভীষণভাবে অপছন্দ করে। আমরা বাঙালিরা যে প্রথম দলে পড়ি তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। পেঁয়াজ-রসুন চিরকাল আমাদের সপ্ত-ব্যঞ্জনের অন্যতম অংশ ছিল। আমাদের এই দলে কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত অনেক জনগোষ্ঠীকে ফেলা যায়। মিশরের ফেরাউনদের যখন মমি করে পরকালের আরাম-আয়েসের জন্য অনেক সম্পত্তি ও সামগ্রী দিয়ে সমাধিস্থ করা হতো, তখন পেঁয়াজ আর রসুনের কাদা ও কাঠের তৈরি প্রতিকৃতি দিয়ে দিতেও ভুল হতো না। পরকালের খাবারগুলোতে পেঁয়াজ রসুনের স্বাদ থাকবে না সে কি কখনো হয়? আদি ইহুদীরা মিশর থেকে বিতাড়িত হয়ে যখন সিনাইয়ের মরুভূমিতে ৪০ বছর ধরে নিরুদ্দেশ বাস করছিল তখন তাদের হাহতাশ ছিল “মিশরের মাছ, তরমুজ, কুমড়া, উটা আর পেঁয়াজ রসুনের জন্য।
পেঁয়াজ রসুন বিরোধীরাও অবশ্য কথনো বিশেষ দূরে ছিল না। সেই প্রাচীন মিশরেও পুরোহিত শ্রেণীরা একে পরিহার করে চলতো অতি সযত্নে। গ্রীক লেখক পুটার্ক তাদের সম্বন্ধে লিখেছেন তারা মনে করতো পেঁয়াজ-রসুন উপবাসেরও উপযুক্ত নয়, ভোজ-উৎসবের উপযুক্ত নয়। কারণ এক দিকে এটা তৃষ্ণা বাড়ায় আবার অন্যদিকে চোখের পানির উদ্রেক করে। প্রাচীন গ্রীকরাও এর বিরোধী ছিল, তারা এর গন্ধকে স্কুল রুচির পরিচায়ক মনে করতো। একই কারণে শেক্সপীয়ারের ‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিমে' বটম তার নাটকের দলকে উপদেশ দিচ্ছে, “কদাচ পেঁয়াজ খেয়ো না, রসুনও নয়; আমাদের উচ্চারণে যেন মিষ্টি খাস বয়।”
রসায়নবিদরা পেঁয়াজ রসুনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বহুকাল ধরে তবে সেটি পেশাগত কারণে। এদের ঝাঝালো গন্ধ, তীব্র স্বাদ আর স্পষ্ট শারীরবৃত্তীয় প্রভাব রাসায়নিক বিশ্লেষণকে উৎসাহিত করেছে। গত এক শতাব্দীর গবেষণার কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। পেঁয়াজ আর রসুন কাটলে তার থেকে নিম্ন আণবিক ওজনসম্পন্ন কিছু অর্গানিক অণু নিঃসৃত হয়। এদের মধ্যে সালফার পরমাণু একটি বিশেষ বন্ধনের
অবস্থায় থাকে যা সচরাচর অন্যত্র দেখা যায় না। এই অণুগুলো খুবই সক্রিয় প্রকৃতির এবং এদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পেঁয়াজের অশ্রুউদ্রেককারী প্রভাবের কথা বলা যায়। পেঁয়াজ আর রসুন থেকে প্রাপ্ত কোন কোন নির্যাস জীবাণু ও ছত্রাকনাশক হিসেবে কাজ করে । আবার অন্য কিছু নির্যাস রক্তকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। পেঁয়াজ আর রসুনে উদ্ভিদতত্ত্বের দিক থেকে একই লিলি পরিবারের দুই ভিন্ন সদস্য—পেঁয়াজের নাম এলিয়াম সেটিভাম আর রসুনের এলিয়াম সেপা। প্রাচীন কাল থেকেই এরী নানা রকম লোকজ ওষুধের কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৫৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লিখিত একটি মিশরীয় প্যাপিরাসের ভাষ্য অনুযায়ী ২২টি বিভিন্ন অসুখে রসুনের উপশমকারী ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হার্টের রোগ, মাথাধরা, বিষাক্ত কামড়, কৃমি এবং টিউমার। গ্রীসে এরিস্টোটল, হিপোক্রেটিস এবং এরিস্টোফানেসের মত পণ্ডিত ব্যক্তিরা রসুনের ওষুধ-গুণের কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রাচীন ভারতে ক্ষতস্থান ধোবার জন্য জীবাণুনাশক লোশন তৈরিতে রসুন ব্যবহার করা হতো। চীনে জ্বর, মাথাধরা, কলেরা আর দাস্তের জন্য পেঁয়াজ দেয়া চা বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
লোকজ ওষুধের সূত্র ধরে আধুনিকতর গবেষণাগুলো পেঁয়াজ আর রসুনকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে। ১৮৫৮ সালে লুই পাস্তুর জানিয়েছেন যে, রসুনের জীবাণুনাশক গুণ রয়েছে। দুই মহাযুদ্ধের সময়ও রসুনকে ক্ষত স্থানের পচন এড়াবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে রসুনের রসকে অনেকখানি পাতলা করে নিলে তা স্টেফাইলোকাস, স্ট্রেপটোক ককাস, ভিব্রিও (কলেরার জীবাণুসহ) ব্যাসিলাস (টাইফয়েঙ, আমাশা, অন্ত্র পীড়ার জীবাণুসহ) গোষ্ঠীর জীবাণুর বৃদ্ধিরোধ করে। তা ছাড়া ক্ষতিকর ছত্রাক ও ঈস্টের বিরুদ্ধে এটা বেশ সক্রিয়।
১৯৭৯ সালে ভারতের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পেঁয়াজ-রসুন কম খায় এমন মানুষের রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি। রক্ত নালী ও হার্টের অসুখের জন্য এদের যে লোকজ ব্যবহার এর একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সাম্প্রতিক আরো কিছু গবেষণার মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে। পেঁয়াজ আর রসুনের সালফার গঠিত যৌগগুলোর মধ্যেই এর বিভিন্ন গুণাগুণ নিহিত রয়েছে। সালফার যৌগগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিষ্কাশন করা হয়। পানিতে রসুনকে সিদ্ধ করে তার বাষ্পের তলিত রূপ থেকে (পাতন পদ্ধতি) পাওয়া যায় ডাই এলাইন ডাই সালফাইড। সাধারণ উত্তাপে ইথাইল এলকোহলে দ্রবীভূত করে পাওয়া যায় এলিসিন যা রসুনের গন্ধের জন্য দায়ী। বরফের চেয়েও নিম্ন উত্তাপে ইথাইল এলকোহল ব্যবহার করে পাওয়া যায় এলিন। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বাষ্পীয় পাতনে পাওয়া যায় এপাইনো এলডিহাইড ও ডাইপাইল ডাই সালফাইড। ফ্রেয়ন ও পানির মিশ্রণকে দ্রাবক হিসেবে ব্যবহার করে পাওয়া যায় অশ্রু উদ্রেককারী অংশ। নিম্ন উত্তাপে ইথাইল। এলকোহলের সাহায্যে পাওয়া যায় একই গুণের সূত্রপাতকারী অংশটুকু।
সত্তরের দশকে রসুনের মধ্য থেকে পাওয়া একটি নির্যাস আজোইনের রাসায়নিক গঠন আবিষ্কৃত হয়—যা রক্ত জমাট বন্ধকারী অংশ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এলিসিনকে পানি ও এসিটোন দ্রাবকের মধ্যে গরম করে এটি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়েছে। দেখা গেছে যে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালী সরু হবার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী এসপিরিন গ্রহণ যতখানি সক্রিয় আজোইন অন্তত ততখানি সক্রিয়।
পেঁয়াজের অশ্রু উদ্রেককারী অংশের রাসায়নিক গঠন বিক্রিয়াগুলোর সন্ধানও সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে। পেঁয়াজ কাটলে এর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রথমে একটা সালফেনিক এসিড পরে যা দ্রুত সত্যিকার অশ্রু উদ্রেককারী অংশে পরিণত হয়। এই অংশটি নিজেও আবার দ্রুত বিক্রিয়াশীল। এর পানিতে দ্রবীভূত হবার গুণটিও লক্ষ্যণীয়। এই কারণে প্রবহমান পানির নিচে পেঁয়াজ ছিললে বা কাটলে এই অংশটুকু ধুয়ে যেতে পারে বলে চোখের জ্বালা কম হয়। তা ছাড়া নিম্ন উত্তাপে এর বাষ্পীভূত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। এ জন্য পেঁয়াজকে বরফে বা ফ্রিজে ঠাণ্ডা করে নিলে তা কাটতে সুবিধা। রসুন আর পেঁয়াজে জীবাণুনাশক ও ছত্রাকনাশক গুণাগুণগুলো তার নিজস্ব নিরাপত্তার খাতিরেই সৃষ্টি হয়েছে। অশ্রু উদ্রেককারী অংশও বিভিন্ন ক্ষতিকারী পশু পাখির কাছে অপ্রিয় বলে এতে নিরাপত্তার কাজে আসে। রসুনের রক্ত জমাট বদ্ধকারী গুণ আজকাল স্বীকৃত বলে এর থেকে নানা রকম ওষুধ পত্র এখন তৈরি হচ্ছে। শুষ্ক যে রসুন গুড়া এই উদ্দেশ্যে তৈরি হয় কিছু পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা তাতে কিন্তু আজোইন বা অনুরূপ অংশগুলো খুঁজে পান নি। এর ভিত্তিতে যে সব পিল, ক্যাপসুল, তেল ইত্যাদি তৈরি হয় তাতেও আসল অংশটুকু খুঁজে পাওয়া যায় নি।
প্রধানত বাষ্পীয় পাতনের মাধ্যমে এসব তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে আসল অংশ নিষ্কাশিত হয় না। তাই আপাতত ওষুধ হিসেবে রসুন গ্রহণ করতে হলে তা তরতাজা রসুন হিসেবেই খাওয়া উচিত, অন্য প্রকারে নয়। পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ অবশ্য অনেক সময় একে তরতাজা খাবার থেকে বিরত রাখে। কিন্তু এটুকু সহ্য না করে উপায় নেই স্বাদ বা ওষুধ পেতে হলে। এদের খাওয়ার পর তার রেশ মুখে এবং দেহে অনেকক্ষণ টের পাওয়া যাওয়ার কারণ হল সালফার কোষগুলো রক্তের মধ্য দিয়ে নিঃশ্বাস ও ঘামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই তাকে গ্রহণ করতে হলে এই উপস্থিতির বোধটুকু মেনে নিতে হবে বৈকি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions