বাদশা আওরঙ্গজেব
সম্রাট শাহজাহানের জীবদ্দশায় সংঘটিত উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে বিজয়ী হয়ে ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আওরঙ্গজেব বাদশাহ আলমগীর উপাধি নিয়ে মোগল সিংহাসনে বসেন। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। ঐতিহাসিক স্টেলি লেনপুল আওরঙ্গজেবকে মোগল বংশের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী শাসক বলেছেন। তিনি আকবর অপেক্ষা বৃহত্তর সাম্রাজ্য শাসন ও বিশালতর সৈন্যবাহিনীর অধিনায়কত্ব করেছিলেন। সম্রাট হয়েও তিনি সরল ও পবিত্র জীবনযাপন করতেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সম্রাট আওরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ ও গোঁড়া মুসলমান হিসেবে অভিযুক্ত করলেও নিঃসন্দেহে তিনি একজন ধর্মপ্রাণ সম্রাট ছিলেন। রাজ্য শাসন ব্যবস্থায় তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোককে রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন। তিনি নিজের সুখ-সুবিধা অপেক্ষা প্রজাদের কল্যাণের কথা বেশি ভাবতেন।
সামরিক সাফল্য
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন সুদক্ষ সমর নায়ক। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ সাহস ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। জীবনে খুব কম যুদ্ধেই তিনি পরাজয় বরণ করেছিলেন। বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চল জয় তাঁর সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর রাজত্বকালে মোগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করেছিল।
কেউ কেউ মনে করেন যে তাঁর এই নীতি ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। অন্যান্যদের ধারণা এই যে, তাঁর নীতির মূল উদ্দেশ্য মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। এ ছাড়াও সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি বা দাক্ষিণাত্যে সামরিক অভিযানের অন্যান্য কারণ হচ্ছে:
১. দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো মোগল সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ ছিল।
২. গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের সুলতানদের কর দিতে অস্বীকৃতি।
৩. মারাঠা নেতা শম্ভুজী সম্রাটের বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে আশ্রয় দান।
৪. দাক্ষিণাত্যে মারাঠারা এ সময় খুব শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং মোগল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল
দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলে আওরঙ্গজেবের রাজ্যসীমা কাবুল থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর থেকে কাবেরী পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল নিম্নরূপ :
১. আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করে গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর রাজ্য দখল করলে পরােক্ষভাবে মারাঠা শক্তি উত্থানের পথ উন্মুক্ত হয়। বস্তুত বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা ছিল। মারাঠাদের স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী মোগলদের নিকট এদের পরাজয়ের ফলে মারাঠারা প্রাথমিক প্রতিদ্বন্ধিতামুক্ত হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পায়।
২. দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলে বিস্তৃত সুবিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে শাসন পরিচালনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
৩. দীর্ঘ সময় সম্রাটের দাক্ষিণাত্যে অবস্থানের কারণে উত্তর ভারতে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আফগান, জাঠ, মেওয়াটি, শিখ ও রাজপুতরা মোগল প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে।
৪. অবিরাম যুদ্ধের ফলে রাজকোষে চরম অর্থ সংকট দেখা দেয়। কৃষি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ অবস্থা মোগল রাজকোষের উপর দারুন চাপ সৃষ্টি করে। রাজকোষ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় সৈন্যদের বেতন বকেয়া। পড়তে থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অসন্তোষ দেখা দেয়। তাই কোনো কোনো ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলে সম্রাট সব কিছু লাভ করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি সব কিছুই হারালেন। ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন, দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের খ্যাতি ও দেহের সমাধি ক্ষেত্র রচিত হয়।
ধর্মপ্রাণ ও শিক্ষানুরাগ মুসলমান
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন বিদ্বান ব্যক্তি। তিনি শিক্ষাবিদদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। মুসলিম ধর্মশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। পবিত্র কুরআন তাঁর মুখস্থ ছিল এবং বহু হাদিস তার জানা ছিল। তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতায় বিখ্যাত ফেকাহ গ্রন্থ ফতোয়া-ই-আলমগিরী প্রণীত হয়। তিনি নিজ হাতে কোরআন শরীফ নকল করতেন ও টুপি সেলাই করতেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব বহু সদগুণের অধিকারী ছিলেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions