সম্রাট শাহজাহান এর ইতিহাস
১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর সম্রাট জাহাঙ্গীর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর শাহজাদা খুররম ও শাহরিয়ারের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শাহরিয়ার শ্বাশুড়ি নূরজাহানের প্ররোচনায় লাহোরে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। শাহজাদা খুররমের শ্বশুর আসফ খান নিজ জামাতাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাকে পরাজিত করেন এবং অন্ধ করে। দিয়ে সিংহাসনের অনুপযুক্ত করে দেন। শাহজাদা খুররম দাক্ষিণাত্যে ছিলেন তিনি আগ্রায় ফিরে আসেন এবং ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি ‘আবুল মুজাফফর শিহাব উদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান বাদশাহ গাজী’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর ত্রিশ বছরের রাজত্বকালে মোগল সাম্রাজ্য গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল।
মোগল ইতিহাসে সম্রাট শাহজাহানের জীবনালেখ্য বৈচিত্রময় ঘটনায় পরিপূর্ণ। একজন জনপ্রিয় সম্রাটরূপে তিনি ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সমরকুশলী হিসেবে সম্রাট শাহজাহান দক্ষতার পরিচয় দেন। মোগল আধিপত্য বিস্তারেও তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তাঁর আমলে আহমদনগর, বিজাপুর, গোলকুণ্ডায় মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি পর্তুগিজদের দমন করে হুগলী দখল করেন।
সুশাসন, ন্যায়বিচার ও বদান্যতার জন্য শাহজাহানের শাসনকাল উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রশাসনের প্রতিটি স্তরের কার্যক্রম নিজে তদারক করতেন এবং প্রজাদেরকে সন্তানতুল্য বিবেচনা করতেন। তবে অপরাধীদেরকে কঠোর শাস্তি দানে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম পশ্চিম এশিয়ার এবং ইউরোপের সাথে ভারতবর্ষের বহির্বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সম্রাট শাহজাহান ছিলেন সৌন্দর্য পিপাসু শিল্পমনা মানুষ। The Prince of Builder নামে খ্যাত সম্রাট শাহজাহানের আমলে মোগল শিল্প ও স্থাপত্যের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। সম্রাটের স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধির উপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ তাজমহল বিশ্বের স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম একটি নিদর্শন ও স্ত্রীর প্রতি তার ভালবাসার অনন্য বহি:প্রকাশ। দেশি বিদেশি কুড়ি হাজার শিল্পী ও কারিগরের বাইশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত তাজমহলকে ঐতিহাসিক হ্যাভেল ভারতের ‘ভেনাস দ্যা মিলো' নামে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া মতি মসজিদ, দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস, জামে মসজিদ তাঁর আমলের স্থাপত্য। শিল্পের অন্যতম কীর্তি। শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন তাঁর শিল্পানুরাগের এক অপূর্ব নিদর্শন। শাহজাহানাবাদ' নামে একটি নতুন নগর তিনি নির্মাণ করা যা বর্তমানে নতুন দিল্লী নামে পরিচিত। এ সকল স্থাপত্য নিদর্শনের নির্মাণ কৌশলে ভারতীয় ও পারসিক স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। তাঁর সময়ে চিত্র শিল্পের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। তিনি হস্তলিপি বিদ্যারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব : সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহ ছিলেন সম্রাটের প্রিয় এবং তিনি পিতার সাথে আগ্রাতে অবস্থান করছিলেন। অন্য তিন পুত্রের মধ্যে সুজা বাংলায়, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে এবং মুরাদ গুজরাটের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় দারা শিকোহ অসুস্থ সম্রাটের শয্যাপাশে থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। দীর্ঘ সময় রাজকার্যে সম্রাটের অনুপস্থিতি এবং দারাশিকোর ক্ষমতা গ্রহণের স্পৃহা শাহজাহানের অন্য তিন পুত্রের ভিতর সন্দেহের সৃষ্টি করে এবং এর ফলে উত্তরাধিকার যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions