সম্রাট জাহাঙ্গীরের অবদান
সামরিক সাফল্য
১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম ‘নুরউদ্দীন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। আকবরের মতো প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন না হলেও তিনি একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের সংহতি বাংলার বার ভূঁইয়াদের দমন এবং মেবার বিজয় করেন। তিনি দাক্ষিণাত্য বিজয়েরও উদ্যোগ গ্রহণ করে ছিলেন।
জনহিতকর কাজ
সম্রাট জাহাঙ্গীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে আকর্ষণীয়, প্রজ্ঞাবান, দয়ালু ও বুদ্ধিমান শাসক। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি কতগুলো জনহিতকর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রজা সাধারণের মন জয়ের চেষ্টা করেন। যারা তাকে সিংহাসন লাভে সহায়তা করেছিলেন তিনি তাদেরকে পদোন্নতি প্রদান করেন। অধিকার যারা তার বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরও তিনি উদারতা ও ক্ষমা প্রদর্শন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার পিতার সময়ের বেশকিছু নির্যাতনমূলক আইন বাতিল করেন এবং ‘দত্তর-উল-আমল’ নামে ১২টি আইন প্রণয়ন করে দয়া ও উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। একজন সাধারণ প্রজাও সরাসরি সম্রাটের বিচারপ্রার্থী হতে পারতেন। ধনী ও গরিব সকলেই যেন তাঁর নিকট সরাসরি বিচারপ্রার্থী হতে পারে সেজন্য সম্রাট ষাটটি ঘণ্টাযুক্ত একটি সোনার শিকল আগ্রার প্রাসাদ থেকে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। যেকোন বিচার প্রাথী শিকলে টান দিলে ষাটটি ঘন্টা একসাথে বেজে উঠত এবং সম্রাট যেখানেই থাকুন না কেন দরবার কক্ষে উপস্থিত হয়ে বিচার প্রার্থীর অভিযোগ শুনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেন।
প্রজাদের প্রতি এমনি দয়া ও মহানুভবতা সত্ত্বেও সম্রাটের চরিত্রে বৈপরীত্যের সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। তাঁর চরিত্রে দয়া-দাক্ষিণ্য ও কোমলতার পাশাপাশি শত্রু দমনে ও অপরাধীর শাস্তি বিধানে কঠোরতা, নিষ্ঠুরতার পরিচয়। পাওয়া যায়।
ধর্ম, শিল্প-সংস্কৃতি ও বাণিজ্য নীতি
সম্রাট জাহাঙ্গীর সকল ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি কোনো প্রকার গোঁড়ামী পছন্দ করতেন না। ফকির, দরবেশ, জ্ঞানী-গুণীদের তিনি সমাদর করতেন। সাহিত্য, শিল্পকলা ও চিত্রশিল্পে তার যথেষ্ট অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। সম্রাট নিজে চিত্রকর ও কবি ছিলেন। তুযুক-ই-জাহাঙ্গীরী রচনা করে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এটি ছিল তাঁর আত্নজিবনী যেখানে সমসাময়িক মোগল ইতিহাসের অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। সাহিত্যের উৎকর্ষতার কারণে তার সময়কালকে অনেকে মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাহিত্যের ‘অগাস্টাস যুগ' বলে অভিহিত করেন। সম্রাটের এতসব গুণ থাকা। সত্ত্বেও মদ্যপান এবং অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে। রাজত্বের শেষভাগে স্ত্রী নূরজাহান ও তাঁর ভাই আসফ খান সম্রাটের উপর বিশেষ প্রভাববিস্তার করেছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের কোনো কোনো অঞ্চলে গোলযোগ দেখা দেয়। ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য তিনি ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের সব রকমের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ইংরেজ বণিকদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন এবং সুরাটে কারখানা নির্মাণের অনুমতি দেন। ক্যাপ্টেন হকিন্স ও টমাস রো নামক দু’জন ইংরেজ দূত ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের পত্র নিয়ে হাজির হন। এসকল দূতরা ভারতবর্ষে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সম্রাটের নিকট থেকে সুবিধা আদায় করেন। তার সময় থেকেই ভারতে ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারের সূত্রপাত ঘটে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions