মুঘল সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি
সম্রাট আকবর ছিলেন ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত ও পরধর্মসহিষ্ণু। সকল ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন সমানুরাগী। তাঁর এই উদার ধর্মীয় নীতির পিছনে নিম্নোক্ত কারণ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
গৃহশিক্ষক ও পারিবারিক প্রভাব:
আকবরের গৃহশিক্ষক আব্দুল লতিফ উদারপন্থী ছিলেন, তাঁর পিতা ও পিতামহ এমন কি মাতা হামিদা বানু কেউই গোঁড়া ছিলেন না। তিনি প্রথম জীবনে সুফি শেখ মুবারক ও তার দুই পুত্র ফৈজী এবং আবুল ফজলের দ্বারা প্রভাবিত হন। বাল্যকালেই তিনি সুফি ধর্মমতের প্রভাবে আসেন। এর ফলে তিনি পারিবারিক ঐতিহ্যে ধর্মীয় উদার ও সহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে বড় হন।
ভক্তি ও মাহদী আন্দোলনের প্রভাব:
ষোল শতক ছিল ধর্ম আন্দোলনের যুগ। আকবর ছিলেন সে যুগের প্রতিচ্ছবি। কবীর, গুরু নানক, শ্রী চৈতন্য, রামানন্দ প্রমুখ মরমী সাধকগণ আকবরের ধর্মনীতিকে প্রভাবিত করেছিলেন। ভারতের ভক্তি ও মাহদী আন্দোলনের প্রভাব জনসাধারণের মনকে সম্রাট আকবরকেও নাড়া দিয়েছিল।
ইবাদত খানায় বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতগণের আলোচনার প্রভাব:
সম্রাট আকবর দর্শন ও ধর্মীয় আলোচনার জন্য ফতেহপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা নির্মাণ করেন। কিন্তু এইখানে আমন্ত্রিত আলেমগণের আলোচনায় তিনি বিদ্বেষ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি, ব্যক্তিগত আক্রমণের মনোভাব ও ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা লক্ষ করেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে এইভাবে সত্যের সন্ধান করা বৃথা। তাই তিনি ‘অভ্রান্ত বা সর্বময় কর্তৃত্বের’ ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা দ্বারা সম্রাট রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ক যেকোনো সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানের ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তবে এর ফলে গোড়া সুন্নী মুসলমানরা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
রাজনৈতিক কারণ:
সম্রাট আকবর উপলব্ধি করেছিলেন ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের দেশ। ফলে মােগল শাসক গোষ্ঠী হিসেবে ভারতীয়দের সহযোগিতা ও সমর্থন লাভ করতে হলে ধর্মীয় ব্যাপারে সহনশীল ও উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে।
দীন-ই-ইলাহী
সম্রাট আকবর ১৫৮২ সালে ‘দীন-ই-ইলাহী' নামে একেশ্বরবাদমূলক এক নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করেন। সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে এই ধর্মমত গঠিত হয়। এই ধর্মমতের কালেমা ছিল 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলিফাতুল্লাহ'।
দীন-ইইলাহী রীতি-নীতি, বিধানগুলো ছিল নিম্নরূপ:
১. এই ধর্মের অনুসারীগণ পরস্পর দেখা হলে, ‘আসসালামু আলাইকুম' এর পরিবর্তে আল্লাহু আকবার' এবং প্রত্যুত্তরে ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম’ না বলে ‘জাল্লাজালালুহু' বলা ।
২. এই ধর্মীয় বিধান অনুসারে মৃত্যুর পরে নয়, মৃত্যুর পূর্বেই দাওয়াত বা আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।
৩. সভ্যগণ নিজ নিজ জন্মদিন পালন এবং ভোজের আয়োজন করবেন।
৪. সভ্যগণ ভিক্ষা প্রদান করবেন কিন্তু ভিক্ষা গ্রহণ করবেন না।
৫. এই ধর্মমত গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হবে না।
ড. ভি. স্মিথের মতে, সংকীর্ণ অর্থে আকবরের দীন-ই-ইলাহী কোনো ধর্ম নয়। এটি ছিল একটি জীবন দর্শন মাত্র। সম্রাট আকবর জোর করে তাঁর ধর্মমত কারও উপর চাপিয়ে দেন নি। এ জন্যই দীন-ই-এলাহীর দীক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র বিশজন। এদের একমাত্র হিন্দু ছিলেন রাজা বীরবল এবং বাকী সকলেই মুসলমান। দীন-ই-এলাহীর মাধ্যমে সকল ধর্মের সারাংশের এক অপুর্ব সংমিশ্রণ সাধন করা ছিল আকবরের উদ্দেশ্য। এর পিছনে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদেরকে একসঙ্গে নিয়ে আসা। দীন-ই-ইলাহী সম্রাট আকবরের মৃত্যুর (১৬০৫ খ্রি.) সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions