বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম
প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাবে বাংলা বানানরীতিতে সংস্কৃত শব্দ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু, অতৎসম শব্দ অর্থাৎ, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, অর্ধ-তৎসম প্রভৃতি উৎস হতে প্রচুর শব্দ বাংলা ভাষায় | প্রবেশ করে। ফলে অতৎসম শব্দের বানানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বানান সংস্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। ফলে রাজশেখর বসুকে সভাপতি করে “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সংস্কার সমিতি” গঠিত হয়। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ঐ সমিতির একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগ ও ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বাংলা বানান নিয়ে নানা সুপারিশ ও নানা প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়ন করে। এরপর ১৯৯২ সালের এপ্রিলে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণের যে উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিলো তা ১৯৯৪ সালে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বানানরীতি ও (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) প্রবর্তিত বানানরীতির সমন্বয়ে বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানরীতি সময়ের দাবি অনুযায়ী যথার্থ। ২০০০ সালে এ নিয়মের কিছু সূত্র সংশোধিত হয়। ২০১২ সালে পুনরায় পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:
বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম :১
তৎসম শব্দ
১.১: এই নিয়মে বর্ণিত ব্যতিক্রম ছাড়া তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে।
১.২: যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ উ উভয় শুদ্ধ কেবল সেসব শব্দে ই বা উ এবং তার কারচিহ্ন হবে। যেমন: কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, চুল্লি, তরণি, ধমনি, ধরণি, নাড়ি, পঞ্জি, পদবি, পল্লি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, যুবতি, রচনাবলি, লহরি, শ্রেণি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা।
১.৩: রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন: অর্জন, উৰ্দ্ধ, কৰ্ম্ম, কার্তিক, কাৰ্য্য, বার্ধক্য, মূৰ্ছা, সূৰ্য্য ইত্যাদির পরিবর্তে যথাক্রমে অর্জন, ঊর্ধ্ব, কর্ম, কার্তিক, কার্য, বার্ধক্য, মূৰ্ছা, সূর্য ইত্যাদি হবে।
১.৪: সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে। যেমন: অহম্ + কার = অহংকার। এভাবে ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। সন্ধিবদ্ধ না হলে ঙ স্থানে ং হবে না। যেমন: অঙ্ক, অঙ্গ, আকাক্সক্ষা, আতঙ্ক, কঙ্কাল, গঙ্গা, বঙ্কিম, বঙ্গ, লঙ্ঘন, শঙ্কা, শৃঙ্খলা, সঙ্গে, সঙ্গী।
১.৫: সংস্কৃত ই-প্রত্যয়ান্ত শব্দের দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপ সমাসবদ্ধ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুযায়ী সেগুলিতে হ্রস্ব ই-কার হয়। যেমন:
গুণী গুণিজন, প্রাণী প্রাণিবিদ্যা, মন্ত্রী → মন্ত্রিপরিষদ।
তবে এগুলির সমাসবদ্ধ রূপে ঈ-কারের ব্যবহারও চলতে পারে। যেমন:
গুণী গুণীজন, প্রাণী প্রাণীবিদ্যা, মন্ত্রী মন্ত্রীপরিষদ।
ইন-প্রত্যয়ান্ত শব্দের সঙ্গে -ত্ব ও-তা প্রত্যয় যুক্ত হলে ই-কার হবে। যেমন:
কৃতী» কৃতিত্ব, দায়ী দায়িত্ব, প্রতিযোগী প্রতিযোগিতা, মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব, সহযোগী সহযোগিতা।
১.৬: বিসর্গ (ঃ)
শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না। যেমন:
ইতস্তত, কার্যত, ক্রমশ, পুনঃপুন, প্রথমত, প্রধানত, প্রয়াত, প্রায়শ, ফলত, বস্তুত, মূলত।
এছাড়া নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে শব্দমধ্যস্থ বিসর্গ-বর্জিত রূপ গৃহীত হবে। যেমন:
দুস্থ, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ, নিশ্বাস।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions