হুমায়ুন ও শেরশাহের যুদ্ধ
হুমায়ুনের সাথে শের খানের সংঘাত
শের খান ছিলেন ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে বিহার প্রদেশের আফগান নেতা। শের খান বাদশাহ বাবরের জীবদ্দশাতেই বিহারের অন্তর্গত সাসারামের সামন্ত শাসক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি চুনার দুর্গের অধিপতি তাজ খানের বিধবা পত্নী লাদ মালিকাকে বিয়ে করে চুনার দুর্গের অধিপতি হন। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ হুমায়ুন চুনার দুর্গ অবরোধ করলে শের খান তাঁর সাথে সন্ধি করেন এবং বাদশাহের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নিজকে রক্ষা করেন। ইতোমধ্যে বিহারের শাসনকর্তা | জামাল খান লোহানী বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের সাহায্যে শের খানকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বীর যোদ্ধা শেরখান এই সম্মিলিত বাহিনীকে সুরাজগড়ের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এভাবে তিনি বিহারের অধিপতি হন। অতঃপর শেরখান বাংলার প্রতি দৃষ্টি দেন। তিনি উপর্যুপরি দু'বার বাংলা আক্রমণ করে রাজধানী গৌড়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন।
বাদশাহ হুমায়ুন পূর্বাঞ্চলে শেরখানের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কিছুটা চিন্তিত হন এবং তাঁকে দমন করার উদ্দেশ্যে ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে সসৈন্যে বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেন। বাংলার পথে হুমায়ুন চুনার দুর্গ আক্রমণ করে অধিকার করে নেন। চুনার দুর্গ জয় করে হুমায়ুন দীর্ঘ ছয় মাস বাংলায় অতিবাহিত করেন। এ সুযোগে শের খান বানারস ও জৌনপুর অধিকার করেন। সুচতুর শেরখান হুমায়ুনের সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হয়ে তাঁর পিছু ধাওয়া করেন। তিনি বিহার ও জৌনপুরে মোগল অধিকৃত অঞ্চল দ্রুত অধিকার করে কনৌজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। শের খান দিল্লির সাথে বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফলে হুমায়ুন আতংকিত হয়ে পড়েন এবং কাল বিলম্ব না করে সসৈন্যে আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। পথে গঙ্গা নদীর তীরে চৌসা নামক স্থানে শেরখান তার গতিরোধ করেন। এই দুঃসময়ে হুমায়ুন তার ভাইদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে শেরখানের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। এ যুদ্ধে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন পরাজিত হন। হুমায়ুনের সৈন্য বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য গঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এতে অনেকের সলিল সমাধি ঘটে। হুমায়ুন কোনো রকমে গঙ্গা পার হয়ে প্রাণ বাঁচান এবং আগ্রায় পৌছেন। কথিত আছে যে তিনি যখন গঙ্গায় নিমজ্জিত হওয়ার উপক্রম হন তখন নিজাম নামে এক ভিস্তিওয়ালা তাঁকে প্রাণে রক্ষা করেন। তিনি তাঁর প্রাণরক্ষাকারীকে বিপুল সম্মানে ভূষিত করেন এবং একদিনের জন্য দিল্লির সিংহাসনে বসান। এই যুদ্ধ জয়ের ফলে বাংলা, বিহার, জৌনপুর, কনৌজ শেরখানের হস্তগত হয়। তার শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তিনি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে, শেরশাহ' উপাধি ধারণ করে রাজকীয় মর্যাদায় নিজেকে ভূষিত করেন। তিনি নিজের নামে খুত্বহ পাঠ ও মুদ্রা ইস্যুর ব্যবস্থা করেন।
বিলগ্রামের যুদ্ধ
বিলগ্রামের যুদ্ধ (১৫৪০ খ্রি.)
চৌসার যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি এবং ব্যর্থতার বেদনা সহ্য করতে না পেরে হুমায়ুন পুনরায় ভাইদের নিকট সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সাহায্য তিনি পান নি। তাই তিনি মাত্র চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে শেরশাহকে | বাধা দেয়ার জন্য কনৌজের পথে অগ্রসর হন। অপর পক্ষে শেরশাহের সৈন্য সংখ্যা ছিল পনের হাজার। তিনি এ সৈন্য নিয়ে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে কনৌজের অদূরে বিলগ্রামে হুমায়ুনের মুখোমুখী হন। উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিলগ্রামের যুদ্ধে হুমায়ুন পুনরায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আগ্রার পথে পলায়ন করেন। শেরশাহ দ্রুত দিল্লি, আগ্রা অধিকার করে নিলে হুমায়ুন পারস্যের দিকে পলায়ন করেন। এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ভারতে সাময়িকভাবে মোগল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং শেরশাহের নেতৃত্বে আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেরশাহের সাফল্য ও হুমায়ুনের ব্যর্থতার কারণ :
শেরশাহের সাফল্য ও হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করা যায়:
১. শেরশাহের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সামরিক দক্ষতা- শেরশাহ ছিলেন কৌশলী ও দূরদর্শী শাসক। তিনি হুমায়ুনকে গৌড় জয় করতে সুযোগ দিয়ে কৌশলে নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন করেন। অন্যদিকে হুমায়ুনের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। চুনার এবং পরে গৌড়ে অযথা কালক্ষেপণ তার অদূরদর্শিতা প্রমাণ করে।
২. বাবরের সাম্রাজ্যের সাংগঠনিক দুর্বলতা- বাবর যে সাম্রাজ্য ও শাসন ব্যবস্থা রেখে যান তা এত দুর্বল, কাঠামোহীন ও ভঙ্গুর ছিল যে হুমায়ুনের পক্ষে তা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। বাবর রাজকোষ শূন্য রেখে যান এবং তিনি সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থা কায়েম করে যেতে পারেন নি। |
৩. সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য- শেরশাহের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নিপুণ সৈন্য দ্বারা সুগঠিত ছিল। কিন্তু হুমায়ুনকে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি সৈন্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল বলে তিনি সৈন্য বাহিনীকে সুগঠিত করার সময় ও সুযোগ পান নি।
৪. হুমায়ুনের চারিত্রিক দুর্বলতা- হুমায়ুন ছিলেন দুর্বল চিত্তের অধিকারী। তিনি তার ভাইদের প্রতি কোমলতা দেখিয়ে পরে অনুতাপ করতে বাধ্য হন। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেছেন যে হুমায়ুনের চরিত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, জেদ ও অধ্যবসায়ের অভাব ছিল। তিনি কোনো বিষয়ে আংশিক সফলতার পর আমোদ প্রমোদে অযথা সময় ব্যয় করতেন।
৫. হুমায়ুনের ভাইদের বিরোধিতা- হুমায়ুনের তিন ভাই কামরান, হিন্দাল এবং আশকারী বিপদের সময়ে হুমায়ুনকে কোনোরূপ সাহায্য করেন নি। ফলে একা হুমায়ুনের পক্ষে দিল্লির সিংহাসন রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।
৬. আফগানদের নিরঙ্কুশ সমর্থন- শেরশাহের প্রতি আফগানদের পূর্ণ সমর্থন ছিল। অন্যদিকে হুমায়ুন তার আপনজনের সমর্থন থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। ফলে হুমায়ুন সিংহাসনচ্যুত হন এবং ভারতের ভাগ্যাকাশে ধুমকেতুর মতো শেরশাহের আবির্ভাব ঘটে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions