সম্রাট বাবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব
বাবরের চরিত্র
তুর্কী ভাষায় ‘বাবর' শব্দের অর্থ ‘সিংহ'। বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি ও দৃঢ়তার জন্য তাঁর এ নামকরণ যথার্থ বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। মধ্য এশিয়ার দুই প্রধান বিজেতা তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের রক্ত তাঁর দেহে প্রবহমান ছিল। বাবরের চরিত্রে উভয় নেতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার একজন যাযাবর যোদ্ধা। যোদ্ধা জাতিসুলভ স্বভাব নিয়ে সমরখন্দ, আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষে ভাগ্যান্বেষণ করেন। মধ্য এশিয়ার জন্য তাঁর ভালবাসা ছিল আন্তরিক। মধ্য এশিয়ার লোকদের স্বভাব অনুযায়ী বাবর যুদ্ধকে জীবনের এক স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে মনে করতেন।
জয় বা পরাজয়ে তিনি ছিলেন অবিচলিত। যুদ্ধের প্রয়োজনে চরম নিষ্ঠুরতা দেখালেও তিনি স্বভাব-নিষ্ঠুর ছিলেন না। যুদ্ধের মধ্যেও তিনি উদ্যান রচনা ও কবিতা রচনার কথা ভাবতেন। বস্তুত বাবরের হৃদয় ছিল কোমল। তিনি তার পরিবারের লোকজনদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন সাহসী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও আত্মবিশ্বাসী, বিপদে তিনি ধৈর্য হারাতেন না। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে তিনি শত্রুপক্ষের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করতেন। সঙ্গীত, কাব্য, সাহিত্যে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে বাবর ছিলেন ফরাসি বীর নেপোলিয়নের মতো আত্মনির্ভরশীল এবং ধৈর্যশীল। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “যোদ্ধা, শাসক ও পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে বাবর মধ্যযুগের একজন আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নরপতি ছিলেন।” বাবর ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু। রাজ্যহারা হয়ে তিনি বহু বিদ্রি রজনী অতিবাহিত করেছেন। তবুও তিনি হতোদ্যম হন নি। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সেহবৎসল পিতা।
শাসক হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের স্থপতি হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তিনি যদি মোগল শক্তিকে ভারতমুখী না করতেন তাহলে মধ্য এশিয়ায় হয়ত উজবেগ জাতির সাথে সংঘর্ষে তারা ধ্বংস হয়ে যেত। তিনি উত্তর ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ধ্বংস করে একক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজপুত এবং আফগান শক্তিকে দুর্বল করে দিয়ে পরবর্তীকালে আকবরের সাম্রাজ্য গড়ার কাজ সহজ করেছিলেন। তিনি ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ এবং সিংহাসনের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেন। বাবরের সাম্রাজ্য পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে বিহার এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে চান্দেরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি মাত্র চার বছর (১৫২৬-১৫৩০ খ্রি.) রাজত্ব করেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে শাসন কাঠামোর কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করতে পারেন নি। তবে তিনি বাদশাহ ও সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা, দিওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা), শিকদার ও কোতোয়াল বা নগরাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। তবে তিনি সামন্ত ও জায়গীরদারদের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করেন।
শিল্প ও সাহিত্যানুরাগী হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব
বাবর শুধু একজন শাসক ও যোদ্ধাই ছিলেন না, শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিও তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তাঁর রচিত তুযুক-ইবাবরী বা বাবরের আত্মজীবনী তুর্কী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। বাবর দিল্লি ও আগ্রায় বেশ কয়েকটি অট্টালিকা, উদ্যান এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য পাকা নর্দমা নির্মাণ করেছিলেন। বাবর পরাজিত আফগান ও রাজপুতদের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে মৈত্রী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বাবর ছিলেন মধ্যযুগের একজন আকর্ষণীয় এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নরপতি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions