১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। লক্ষ্ণৌচুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে এক যৌথ দাবিনামা সরকারের নিকট পেশ করে। এ দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং ভারতবাসীকে আরো অধিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার আইন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষে ভারত সচিব মন্টেগু ও ভারতের বড়লাট চেমসফোর্ড একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। এর ভিত্তিতেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে একটি শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইন পাস করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ সংস্কার আইন ‘মন্টেগু-চেমফোর্ড সংস্কার আইন নামে পরিচিতি।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কার্যাদি যথাসম্ভব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র সম্পর্ক, মুদ্রা, বাণিজ্য, রেল ও ডাক প্রভৃতি সর্বভারতীয় বিষয়গুলো ন্যস্ত করা হয়। প্রদেশের হাতে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা, বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেল, সেচ, স্থানীয় সরকার প্রভৃতির দায়িত্ব রাখা হয়। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সরকারী আয় ও বণ্টন করে দেয়া হয়।
এ আইনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। পূর্বের ন্যায় ভারতের বড়লাট ও ভারত সচিব বৃটিশ পার্লামেন্টের নিকট দায়ী থাকেন, ভারতীয় আইন সভার নিকট নয়। ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভাকে পুনর্গঠন করে রাষ্ট্র পরিষদ ও আইন পরিষদ নামে দুটি কক্ষে ভাগ করা হয়। রাষ্ট্রপরিষদ বা উচ্চকক্ষের সদস্যসংখ্যা ৬০ জনে নির্ধারিত করা হয়, এর মধ্যে ৩৪ জন নির্বাচিত সদস্য ও বাকী ২৬ জন বড়লাট কর্তৃক মনোনীত হবেন। আইন পরিষদ বা নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয় ১৪৫ জনে, এদের মধ্যে ১০৫ জন নির্বাচিত এবং বাকীরা মনোনীত হবেন। মনোনীতদের মধ্যে ২৬ জন সরকারী কর্মচারী এবং অবশিষ্ট হবেন বেসরকারী সদস্য। রাষ্ট্রপরিষদ ও আইন পরিষদের মেয়াদ যথাক্রমে ৫ ও ৩ বছর করা হয়। রাষ্ট্র পরিষদেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এ আইনে মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়াও | পাঞ্জাবের শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, এ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপীয়গণও পৃথক নির্বাচনের সুযোগ ও অধিকার লাভ করে।
যদিও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছিল, তথাপি কেন্দ্রীয় আইন পরিষদকে সমগ্র ভারতের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। কোন কোন বিষয়ে আইন সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্বে বড়লাটের অনুমতি নেয়ার বিধান রাখা হয়। অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তাব একমাত্র আইন পরিষদেরই বিবেচনার এখতিয়ার নির্ধারিত হয়। তবে কোন বিল বা আইনের খসড়া আইন পরিষদে অগ্রাহ্য হলেও বড়লাট তা কার্যকরী করতে পারতেন। ফলে এ বিষয়ে | আইন পরিষদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী বার্মা ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ মোট দশটি গভর্নর শাসিত প্রদেশ ছিল। প্রচুর ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী গভর্নর প্রদেশের যথার্থ কর্তৃত্বের অধিকারী হন। প্রাদেশিক শাসন কার্য ‘সংরক্ষিত’ ও ‘হস্তান্তরিত'-এ দুভাগে ভাগ হয়ে এক ধরনের দ্বৈত শাসনের সূত্রপাত ঘটায়। আইন-শৃংখলা, অর্থ, পূর্ত, বিচার, রাজস্ব প্রভৃতি বিষয়গুলো সংরক্ষিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং গভর্নর ও তাঁর শাসন পরিষদ কর্তৃক শাসিত হতো। পক্ষান্তরে শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় শাসন প্রভৃতি হস্তান্তরিত বিষয়াদির অধীনে থাকে। গভর্নর তার মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে এগুলো শাসন ও পরিচালনা করবেন। এসব দায়িত্ব পালনের জন্য মন্ত্রীসভা প্রাদেশিক আইন সভার নিকট দায়ী ছিল। সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত উভয় বিষয়গুলোর উপর গভর্নরের অবাধ কর্তৃত্ব বহাল রাখা হয়। গভর্নর প্রাদেশিক আইন সভার সদস্যগণের মধ্য হতে যেকোন সদস্যকে মন্ত্রী নিয়োগ করার অধিকারী হন।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে বৃটিশ ভারতের প্রদেশগুলোতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার ব্যবস্থা রাখা হয় এবং এর সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। তা ছাড়া এ আইনে প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা শতকরা ৭০ জনের কম এবং সরকারী সদস্যের সংখ্যা ২০ জনের অধিক হবে না বলা হয়।
এ আইনে ইংল্যান্ডে ভারতীয় হাই কমিশনার পদের সৃষ্টি হয়। তিনি সেখানে ভারতীয় ছাত্র ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেন। ভারত সরকার কর্তৃক তিনি ৫ বছরের জন্য নিয়োগ পেতেন। শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দিক থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ছিল নি:সন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। প্রথমত, এ আইন দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের প্রথা চালু হয় এবং ভোটাধিকারও সম্প্রসারিত হয়। দ্বিতীয়ত, আইন সভার নিকট দায়ী মন্ত্রীপরিষদ এর মাধ্যমে গঠিত হয়। এসব মন্ত্রীরা ছিলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও বেসরকারী ব্যক্তি। সুতরাং এতে দায়িত্বশীল সরকারের সূচনা হয়েছিল বলা যায়। তৃতীয়ত, এ আইনের ফলে ভারতীয় জনগণ রাজনৈতিক জ্ঞান ও শাসনকার্যের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায়।
তবে এ আইনের সমালোচনাও ছিল। কংগ্রেস অধিবেশনে এ আইনকে অপর্যাপ্ত ও নৈরাশ্যজনক বলে অভিহিত করা হয়। বস্তুত যথার্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বিচার করলে কেন্দ্র ও প্রদেশের শাসন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এ আইনের ত্রুটি চোখে পড়ে। প্রথমত, সর্বক্ষেত্রেই কার্যনির্বাহক পরিষদ আইনসভার নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, প্রদেশের শাসনকার্য সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এ দুভাগে ভাগ করে একদিকে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব ও অন্যদিকে দায়িত্বহীন ক্ষমতা অর্পনের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় এবং প্রশাসনিক দক্ষতা নষ্ট হয়। দায়িত্বশীল সরকার গঠনের পথে এটা অন্তরায় সৃষ্টি করে।
শেষে বলা যায় যে, মর্লি-মিন্টো সংস্কারের ব্যর্থতা নতুনভাবে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিকে জোরালো করে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ লক্ষ্ণৌচুক্তি নামে এক যৌথ দাবিনামায় ভারতীয়দের পক্ষ থেকে নিজেদের কথা তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার বা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে ঐ দাবিনামার কিছু বৃটিশ সরকার বিবেচনা করে। কিন্তু তা সত্বেও দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তন বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠা ভারতীয়দের কোনো দাবিই গৃহীত হয় নি। বস্তুত ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনে এক প্রকার এককেন্দ্রিক শাসনই প্রতিষ্ঠিত হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions