ব্রিটিশ শাসনামলে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তন / কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি
ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রায় সমগ্র উপমহাদেশ একই শাসন কর্তৃপক্ষের অধীনে আসায় ভারতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। এতে জাতীয় ভাবধারা গড়ে উঠার পথ সুগম হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ ভারতীয়দের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে উনিশ শতক শেষার্ধে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হয়। তারা শাসন ব্যবস্থায় নিজেদের প্রতিনিধিত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চ শিক্ষিত ও অভিজাত শ্রেণির আকাক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন' বা ভারত সভা। আরও পরে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয় সর্বভারতীয় সংগঠন ‘সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস'। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি উদাসীন থাকার ফলে এবং বিদেশি শাসনের সংগে সহযোগিতা না করার ফলে ভারতীয় মুসলমানরা অত্যন্ত পিছিয়ে পড়ে। তাদের সেই দুর্দিনে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং বাংলার নেতা নবাব আবদুল লতিফ ও স্যার সৈয়দ আমির আলী। তারা মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ ও ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করার নীতিতে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক নবচেতনা ও জাগরণের। হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের প্রভাব, জাতীয় কংগ্রেস থেকে মুসলমান সম্প্রদায়কে দূরে রাখার মুসলিম নেতৃবৃন্দের নীতি, বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থায় তাদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব বজায় রাখা এবং চাকুরি ও শিক্ষার অধিকারসহ সর্বত্র আলাদাভাবে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টার ফলে তাদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র চেতনা ও বোধ অঙ্কুরিত হয়। লর্ড কার্জনের প্রশাসনিক সংস্কার এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন সে বোধকে আরো শাণিত করে। এই পটভূমিতেই ঢাকায় জন্ম নেয় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ' নামে মুসলমানদের পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সামান্য কিছুদিন আগে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থায় স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি করা হয়। জাতীয় কংগ্রেস মুসলমানদের সে দাবির বিরোধিতা করলেও ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা | মেনে নেয়। উল্লেখ্য যে, ভবিষ্যৎ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা একটা যুগান্তকারী ঘটনা। যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ সে সময়টা ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশের ঊষালগ্ন। বৃটিশ নীতি ও শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে ক্রমশ ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে। ফলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ও পরে কয়েকটি ছোট ছোট রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠে। এ সবের উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি'। ভারতীয় জনগণের নায্য অধিকার আদায়ের জন্য জনমত গঠন ছিল এই সংগঠনের লক্ষ্য। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন'। কিন্তু এসব সমিতি শিক্ষিত অভিজাত ও জমিদারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকায় মধ্যবিত্ত বা সাধারণ জনগণের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের অনুকরণে বোম্বে ও মাদ্রাজে অনুরূপ সংগঠন গড়ে উঠে। শাসন সংস্কারের মাধ্যমে দেশ শাসনে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি ও তাদের নায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠান জনমত গঠনের চেষ্টা করে। বাংলার নেতা সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতায় ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন' বা ভারত সভা নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব বজায় রাখা এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কাজ করেন। উল্লেখ্য, এ সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত কলকাতায় হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি চাকুরীসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে।
ভারত উপমহাদেশে এরূপ পরিস্থিতিতে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ভাইসরয় হয়ে আসেন। তাঁর সময়কালের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপের দরুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়সসীমা একুশ থেকে উনিশে আনা হলে সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে আগ্রা, দিল্লী, আলীগড়, লাহাের, কানপুর, বেনারস ও অমৃতসরসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে প্রতিবাদ সভা হয়। এ বিক্ষোভের পরপরই শুরু হয় ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ভার্নাকুলার প্রেস এ্যাক্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এ আইনের মাধ্যমে বৃটিশ সরকার দেশীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছিলেন। সরকারের বর্ণ বৈষম্যমূলক অস্ত্র আইন, সাম্রাজ্যবাদী আফগান যুদ্ধ, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের আঁকজমকপূর্ণ দিল্লী দরবার ইত্যাদিও অসন্তোষের মূলে ছিল।
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি
ইউরোপীয়ানদের বিক্ষোভ ভারতীয়দের মর্যাদা ও জাতীয় চেতনায় আঘাত করে। শিক্ষিত হিন্দুরা সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দ মোহন বসুর নেতৃত্বে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতায় এলবার্ট হলে এক সম্মেলনে মিলিত হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত প্রতিনিধিরা একটি সর্বভারতীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এ দিকে ভারতীয়দের মধ্যে বিক্ষোভ এবং অধিকার আদায়ের জন্য সচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আন্দোলনের চাপে বৃটিশ সরকার কিছুটা ভীত হয়। ভারতীয়দের দাবি ও আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করার এবং তাদের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য সরকার মনোযোগী হয়। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের জনৈক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এলান অক্টেভিয়ান হিউম ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের সহযোগিতায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বে শহরে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) প্রতিষ্ঠা করেন। দুজন মুসলমানসহ সত্তর জন প্রতিনিধি কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে যোগ দেয় এবং এর সভাপতি নির্বাচিত হন বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী।
বক্তৃতায় তিনি কংগ্রেসের চারটি উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেন:
১. ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যাঁরা দেশ সেবায় ব্রতী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করা;
২. জাতি ধর্ম আঞ্চলিকতার সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় ঐক্যের পথ সুগম করা;
৩. শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যেমে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পথে বের করা এবং
৪. রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য পরবর্তী বছরের কর্মসূচী নির্ধারণ করা।
উল্লেখ্য যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস হচ্ছে বৃটিশ শাসনাধীনে ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রথম জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন। প্রথম দিকে অল্প কয়েকজন মুসলমান এতে যোগদান করেন। কিন্তু এর কর্মসূচি মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় পরবর্তী সময়ে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং কিছু মুসলিম নেতারা মুসলমান সম্প্রদায়কে কংগ্রেসের সাথে জড়িত হতে নিষেধ করেন। প্রথম দিকে কংগ্রেস নেতারা প্রায় সবাই ছিলেন মধ্যপন্থী। ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান হতো। কিন্তু সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের ও সহযোগিতার এ নীতি অচিরেই পরিবর্তিত হতে থাকে। কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে ভারতের জন্য স্বরাজ বা স্বাধীনতার আন্দোলন করে এবং সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী বিরোধী দলে পরিণত হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions