বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গবিভাগের কারণে বাংলার উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা শীঘ্রই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী একটি সুসংহত আন্দোলনের রূপ নেয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পাশাপাশি বিদেশী পণ্য বর্জন বা বয়কটের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ব্রিটিশ বিরোধী প্রসিদ্ধ স্বদেশী আন্দোলনের। চরমপন্থীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে প্রচণ্ড শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এ আন্দোলন থেকে দূরে থাকলেও সাধারণভাবে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষত বর্ণ-হিন্দুরা এর নেতৃত্ব দেয়। জাতীয় কংগ্রেস ছিল এ আন্দোলনের পুরোভাগে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, জমিদার শ্রেণি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও সাংবাদিক সবাই এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। বক্তৃতা মঞ্চ ও পত্র-পত্রিকায় বঙ্গবিভক্তিকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ ‘জাতীয়তাবাদ বিরোধী' ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়। নতুন সৃষ্ট পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে মুসলমানরা সংংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়াতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ঈর্ষার উদ্রেক করে। কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী এক প্রতিবাদ সভায় বলেন, “নতুন প্রদেশে মুসলমানরা হইবে সংখ্যাগুরু আর বাঙালী হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ঠ। ফলে স্বদেশেই আমরা হইব প্রবাসী” । নিছক স্বার্থবোধ ও ধর্ম-ভিত্তিক সংকীর্ণ জাতীয় চেতনা থেকেই মূলত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত। এ আন্দোলন ছিল প্রধানত কলকাতা কেন্দ্রিক। জমিদার, পুঁজিপতি শ্রেণি ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ছিল এর অগ্রভাগে। বৃটিশ শাসনের শুরু থেকে এরা ছিলেন সুবিধাভোগী। জমিদারেরা তাদের প্রজাদের শোষণ করে বিপুল ঐশ্বর্য গড়ে তোলে এবং তাদের নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচারে কৃষকরা আর্থিক ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
ঢাকায় রাজধানী স্থাপিত হলে নতুন প্রদেশে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে, নতুন পুঁজিপতি শ্রেণির জন্ম হবে। ফলে তাদের একচেটিয়া ব্যবসা ও মুনাফা নষ্ট হবে এ আশংকায় কলিকাতার ধনিক শ্রেণি ও ব্যবসায়ীরা নতুন প্রদেশ গঠনের ব্যাপারে বিরূপ মনােভাব পোষণ করে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, আইনজীবী এবং সাংবাদিকতার পেশায় জড়িতরাও অনুরূপ কারণে ভীত ছিল। সে কারণে তারা সকলেই নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ ও প্রাধান্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, অশ্বিনী কুমার দত্ত, মহারাষ্ট্রের তিলক প্রমুখ নেতারা জাতীয়তাবাদের চেতনায় এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
হিন্দু সমাজের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে জাতীয় কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। অনেকগুলো প্রতিবাদ সভা থেকে বঙ্গ বিভক্তি বাতিলের দাবি জানানাে হয়। আন্দোলন জোরদার করার জন্য কংগ্রেস ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট কলিকাতার এক জনসভা থেকে বৃটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবার দিনে হিন্দুরা ‘রাখীবন্ধন অনুষ্ঠান পালন করে এবং মিছিল ও সভাসমিতিতে ‘বন্দে মাতরম' ধ্বনি দেয়। শীঘ্রই স্বদেশী আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদেশি পণ্য আমদানি ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হয়। দেশীয় শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠে। আন্দোলনকারীরা বিলাতী পণ্যের সঙ্গে ইংরেজদের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বর্জনের আহ্বান জানায়। ছাত্ররা সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কর্মসূচিকে জোরদার করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বিশেষত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও কবি-সাহিত্যিকরা এ আন্দোলনকে জোরদার করতে মূল্যবান অবদান রাখে। সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জীর ‘বেঙ্গলী’ এবং মতিলাল ঘোষের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা প্রতিরোধ আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র লাল, রজনীকান্ত, মুকুন্দদাস প্রমুখ কবিদের রচিত দেশ বন্দনামূলক গান আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঐ সময়ে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” গানটি রচনা করেন যা আজ আমাদের জাতীয় সংগীত। বস্তুত স্বদেশী আন্দোলনকালে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে দেশাত্মবোধক ভাবের এক নতুন জোয়ার আসে।
বঙ্গভঙ্গের প্রথম বর্ষ পূর্তি কংগ্রেস ও হিন্দুরা শোক দিবস হিসেবে পালন করে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ক্ষেত্র বিশেষে সহিংসতার পথে ধাবিত হয়। আন্দোলনকারীদের একাংশ চরমপন্থী নেতাদের প্ররোচনায় উগ্রপন্থী কার্যকলাপ শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের পতন ঘটান। ঢাকা ও কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়। এদের মধ্যে ঢাকার অনুশীলন এবং কলকাতার ‘যুগান্তর' সমিতি ছিল প্রধান। ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্যারিস্টার প্রমথ নাথ মিত্র। এ সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় পুলিন বিহারী দাসের উপর । ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিপ্লবীদের দ্বিতীয় দল ‘যুগান্তর সমিতি’র জন্ম হয়। অরবিন্দ ঘোষ, বারিন্দ্র ঘোষ ও ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত এ সমিতির উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন। যুগান্তর' নামে সমিতির একটা পত্রিকা ও প্রকাশিত হয়।
সারাদেশ গুপ্ত সমিতিগুলোর অনেক শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠে। শরীরচর্চা ছাড়াও এসব সমিতির মাধ্যমে যুবকদের অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শতশত যুবক ও ছাত্র এ আন্দোলনে যোগ দেয়। গুপ্ত হত্যার দ্বারা ইংরেজদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। বিপ্লবী যুবকরা পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলার-কে দু’বার হত্যার চেষ্টা করে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী এই আন্দোলনে জড়িত হয়ে জীবন উৎসর্গ করেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। লর্ড মিন্টোর পরে নতুন ভাইসরয় হয়ে আসেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। তিনি কংগ্রেসী নেতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আপোসনীতি গ্রহণ করেন এবং বঙ্গভঙ্গ রদ করতে মনস্থ করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের দিল্লী দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা দেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions