গোল টেবিল বৈঠক
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতে ‘আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল। সে বছরের মে মাসে সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল এ রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। সে অবস্থায় বৃটিশ সরকার লন্ডনে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে এক গোল টেবিল বৈঠক আহবান করেন। উদ্দেশ্য ভারতে বিরাজমান পরিস্থিতি ও সংকটের নিরসনকল্পে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ এবং ভারতের ভবিষ্যত সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন করা। আহূত বৈঠক তিনটি অধিবেশনে সমাপ্ত হয়।
প্রথম গোলটেবিল বৈঠক
গোল টেবিল বৈঠকের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর। অধিবেশনে বৃটেনের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে ১৬, ভারতীয় রাজন্যবর্গের পক্ষে ১৩ এবং বৃটিশ শাসিত ভারত থেকে ৫৭ জন সহ সর্বমোট ৮৯ জন সদস্য যোগ দেন। কংগ্রেস এ অধিবেশনে যোগ দেয় নি। উপস্থিত ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা ড. আম্বেদকার, মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এবং তেজ বাহাদুর সা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে মেকডোনাল্ড এ বৈঠকে কতগুলো সংবিধানিক প্রস্তাব দেন; তার মধ্যে ১. ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠন, ২. প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার এবং ৩. কেন্দ্রে আংশিক দায়িত্বশীল সরকার গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো অন্যতম।
ভারতের রাজন্যবর্গের প্রতিনিধিরা মোটামুটিভাবে প্রস্তাবগুলো মেনে নেন। কিন্তু মুসলিম প্রতিনিধিরা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের দাবি করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমান সম্প্রদায়ের ন্যূনতম দাবি হিসেবে তার চৌদ্দ দফা দাবির পুনরুল্লেখ করেন। তপসিলী সম্প্রদায়ের তরফ থেকে ডক্টর আম্বেদকারও পৃথক নির্বাচনের দাবি করেন। হিন্দু প্রতিনিধিরা
যৌথ নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন, যদিও তারা সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষন নীতি সমর্থন করেন। যা হোক, সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে মতদ্বৈততার কারণে কংগ্রেস এ বৈঠক বর্জন করায় গোল টেবিল বৈঠক মুলতবি হয়ে যায়।
দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক
গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। কংগ্রেসের একক প্রতিনিধিরূপে এম. কে গান্ধী এ বৈঠকে যোগদান করেন। ফেডারেল ব্যবস্থা ও সংখ্যলঘু প্রশ্ন-এ দুটি ছিল বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়। শুরুতে গান্ধী কংগ্রেসকে ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধিত্বের একমাত্র দাবিদার বললে উপস্থিত অন্যান্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে এর কড়া প্রতিবাদ জানান। মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তনের ব্যাপারে এর পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিন্তু গান্ধী এতে রাজী ছিলেন না। তিনি বরং অবিলম্বে কেন্দ্রে ও প্রদেশে একই সঙ্গে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। বড়লাটের বিশেষ ক্ষমতারও তিনি বিরোধিতা করেন। কিন্তু সংখ্যলঘুদের প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলে গান্ধীর প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রভাব হ্রাস করার উদ্দেশ্যেই মুসলমান, শিখ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং অনুন্নত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণের দাবি জানায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে পৃথক নির্বাচন প্রথা বহাল রাখার আবেদন করেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় নি। গান্ধী শত চেষ্টা করেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের স্বমতে আনতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি মেকডোনাল্ড ঘোষণা করেন যে, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান না হলে সংবিধান রচনা করা সম্ভব নয়। ভারতবাসী এ বিষয়ে একমত হলেই তবে বৃটিশ সরকারের কিছু করণীয় আছে। এভাবে কোনো সমস্যারই সঠিক সমাধান দিতে পারে নি গোল টেবিল বৈঠকের দ্বিতীয় অধিবেশন। ফেডারেল পদ্ধতি, সম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের বিষয়, কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্ক এ সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব সমস্যা সামনে রেখেই ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর গোল টেবিল বৈঠকের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ হয়।
তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক
গোল টেবিল বৈঠকের তৃতীয় অধিবেশন বসে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়। আগের দুটি অধিবেশনের তুলনায় অনেক কম প্রতিনিধি এতে অংশ গ্রহণ করেন। কংগ্রেসও এ অধিবেশনে প্রতিনিধি পাঠায় নি। তিনটি বিষয় এ সম্মেলনে গুরুত্ব লাভ করে, যথা-
১. কি কি শর্তের ভিত্তিতে রাজ্যগুলো ফেডারেশনে যোগ দেবে,
২. অবশিষ্ট ক্ষমতার বণ্টন এবং
৩. বৃটিশ শাসনের গ্যারান্টি।
প্রতিনিধিবর্গের অনেক দাবি বৃটিশ সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। যা হোক, ভারতে তখনও আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল। ভারতীয় জনগণের উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্যে বৃটিশ সরকার গোল টেবিল আলোচনার ফলাফল একটি শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করে। যদিও এসব প্রচেষ্টায় শাসনতান্ত্রিক সমস্যার কোনো সমাধান সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions