আব্বাসীয় খিলাফত
ভূমিকা
আব্বাসীয় শাসনের সূত্রপাত হয় উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর। যারা ৭৫০ থেকে ১২৫৮ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কাল শাসন ক্ষমতায় ছিল। এই সময়টি ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। মুসলিম সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশে এই বংশ এক মাইলফলক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এটি ছিল মূলত ইসলামী কৃষ্টি, সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক যুগ। এই বংশে সর্বমোট ৩৭ জন খলীফার আবির্ভাব ঘটেছে। উমাইয়া খিলাফতকাল ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে একক আধিপত্যের যুগ, কিন্তু আব্বাসীয় শাসনকালের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মুসলিম খিলাফত ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খিলাফত, মিসরের কায়রোয়ান কেন্দ্রিক ফাতিমীয় খিলাফত ও স্পেনের কর্ডোভা কেন্দ্রিক উমাইয়া খিলাফত। এছাড়া এই বংশের শেষ দিকে দুর্বল সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির কারণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের উদ্ভব ঘটে যা এই শাসনামলের একটি গুণগত বৈশিষ্ট্য। এতে আরব অনারব দ্বন্দ্ব ছিল না। একক আরবীয় জাতীয়তাবাদের স্থলে বিশ্বজনীন মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। আরবীয়দের স্থলে পারসিকদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় শাসনে খলীফার পর উযির পদ্ধতির প্রথম সূচনা। বাগদাদ পরিণত হয় মুসলিম রাজনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে।
সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগকে পেছনে ফেলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে মুসলিমগণ এই খিলাফতের মাধ্যমে প্রবেশ করে। ৫০৮ বছর শাসন করে আব্বাসীয় খিলাফত পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী শাসনকালের ইতিহাস গড়ে। আবুল আব্বাস আস-সাফফার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বংশ আবু জাফর আল মনসুর, হারুন অর-রশীদ ও আল-মামুনের মত শ্রেষ্ঠ খলীফাদের মাধ্যমে ইতিহাসে | কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম। অবশেষে ১২৫৮ খ্রি: হালাকু খান কর্তৃক বর্বরোচিত আক্রমণে সর্বশেষ খলীফা আল মুসতাসিম বিল্লাহর হত্যার মধ্য দিয়ে এই খিলাফতের অবসান ঘটে।
নামকরণ ও পরিচয়
আব্বাসীয় খিলাফতের নামকরণ হয়েছে মহানবী (সাঃ) এর চাচা আল-আব্বাসের নাম হতে। তাঁর নামানুসারে এই বংশের নামকরণ হয়েছে আব্বাসীয় বংশ। তিনি আল-আব্বাস আব্দুল্লাহ, ফজল, উবায়দুল্লাহ ও কায়সার নামে ৪ পুত্র রেখে ৩২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তারা প্রত্যেকেই হযরত আলী (রা.) এর পক্ষ অবলম্বন করেন। আব্দুল্লাহ ইতিহাসে ‘ইবনে আব্বাস' নামে পরিচিত। তিনি একজন প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা ছিলেন। ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালার যুদ্ধে নিহত হলে তিনি ভগ্নহৃদয়ে ৬৮৭ খ্রি. ৭০ বছর বয়সে তায়িফে ইন্তিকাল করেন। এরপর তাঁর পুত্র আলী পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আব্বাসীয় আন্দোলনের উৎপত্তি
৭৩৫ খ্রি: আলী (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ পরিবারের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ অতিশয় উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সর্বপ্রথম রাজক্ষমতা দখলের ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি নিজেকে খিলাফতের ন্যায্য দাবিদার ভাবতেন।
হযরত ফাতিমা (রা.) এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) হানাফিয়া গোত্রের জনৈকা রমণীকে বিবাহ করেন এবং মুহাম্মদ আল-হানাফীয়া তাঁর গর্ভজাত পুত্র ছিলেন। কারবালার ঘটনায় ইমাম হুসাইন (রা.) এর মৃত্যুর পর ইসলামের ধর্মীয় নেতৃত্ব ইবনুল হানাফিয়ার হাতে অর্পিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হাশিম নেতৃত্ব লাভ করেন। হাশিম তার মৃত্যুর পূর্বে ইবনে আব্বাসের প্রপৌত্র মুহাম্মদকে ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্পন করেন। মুহাম্মদ তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নের পূর্বেই ৭৪৪ খ্রি: মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তদ্বীয় ৩ পুত্র ইব্রাহিম, আবুল আব্বাস ও আবু জাফরকে পরপর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান।
সমর্থন ও অনুকূল পরিবেশ
আবুল আব্বাসের বংশধরগণ ছিলেন হাশিমী গোত্রভুক্ত ও মহানবী (সাঃ) এর নিকটাত্মীয়। তাই Ahl-al-Bayt এর পাশে তাদের এই আন্দোলনকে জনগণ স্বাগত জানায়। বিশেষ করে শিয়া মুসলিম ব্যাপকভাবে তাদের সমর্থন জানায়। উমাইয়া শাসনের কুপ্রভাব, কারবালার ঘটনা, আরব-অনারব বৈষম্য, গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ইত্যাদি উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে জনমনে বীতশ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়। তারা এই শাসনের সমাপ্তি কামনা করে। পারস্য অঞ্চলের মাওয়ালী মুসলিম ও সুন্নী মুসলিমগণের মনে উমাইয়াদের নৈতিক অধঃপতন ও ইসলাম হতে বিচ্যুতি ও বৈষম্যমূলক আচরণ হতে পরিত্রাণ পাবার আশায় আহলে বায়াতের নামে এই আব্বাসীয় আন্দোলনকে স্বাগত জানায়। এভাবে আব্বাসী আন্দোলন সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে একটি সর্বর্তনীন রূপ লাভ করে।
আবু মুসলিমের আবির্ভাব
মূলত উমাইয়া খলীফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের সময় হতেই এই আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এর ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। হিশামের মৃত্যুর পর এই আন্দোলন আরো জোরদার হয় এবং দ্বিতীয় মারওয়ানের শাসনামলে তা তীব্র আকার ধারণ করে।
ইব্রাহীম এই সময় আব্বাসীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সৌভাগ্যক্রমে এই সময় আবু মুসলিম খোরাসানী নামক আরব বংশোদ্ভূত ইস্পাহানবাসীর আবির্ভাব ঘটে যিনি নিজেকে আব্বাসীয় প্রচার কাজে সম্পৃক্ত করেন। তিনি একজন দক্ষ সামরিক সংগঠক ও কৌশলী সেনানায়ক ছিলেন। তিনি খোরাসান অঞ্চলে আব্বাসীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন।
খোরাসান দখল
খোরাসান অঞ্চলে ব্যাপক প্রচার অভিযানের ফলে আবু মুসলিম খোরাসানী ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন। এর মধ্যে খারিজী, শিয়া ও মাওয়ালীদের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। খোরাসান আব্বাসী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। খলীফা মারওয়ান তখন সিরিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। খোরাসানের সর্বশেষ উমাইয়া গভর্ণর নসর বিন সাইয়্যার কিরমানের খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে আবু মুসলিম খোরাসানের রাজধানী মার্ভ দখল করেন (৪৭৭ খ্রি:)। নসর আবু মুসলিমের সেনাপতি কাহতাবা কর্তৃক পরাজিত হন ও মারওয়ান কর্তৃক প্রেরিত সাহায্য পৌছাবার পূর্বে নসর পলায়নরত অবস্থায় নিহত হন। এভাবে খোরাসান আব্বাসীদের হস্তগত হয়।
ইব্রাহিমের কারাবরণ
খলীফা মারওয়ান আব্বাসীয় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবে ইব্রাহিমকে বন্দী করেও কারাগারে পাঠান। তবুও সমানগতিতে এই আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। আবু মুসলিমের সেনাপতি কাহতাবা ও খালিদ ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে উমাইয়া সেনাপতি ইয়াজিদকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে ইয়াজিদ পরাজিত হন, কাহতাবা নিহত হলে তাঁর পুত্র হাসান আব্বাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। আবু মুসলিমদের অপর সেনাপতি আবু আয়ান মারওয়ানের পুত্র আব্দুল্লাহকে পরাজিত করে নিহাওয়া ও মেসোপটেমিয়া অধিকার করেন। এই সংবাদ পেয়ে মারওয়ান ইব্রাহীমকে হত্যার নির্দেশ দেন। ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর আবুল আব্বাস আস-সাফফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
আবুল আব্বাসের খিলাফত ঘােষণা
ইব্রাহীমের বন্দী অবস্থায় তাঁর ভ্রাতাগণ কুফায় আত্মগোপন করেন এবং ইবনে কাহতাবা কর্তৃক কুফা অধিকৃত হওয়া পর্যন্ত তারা আত্মগোপনে থাকেন। ৭৪৯ খ্রি: কুফা বিজিত হয় এবং আবুল আব্বাস কুফার মসজিতে খলীফা হিসেবে ঘােষিত হন। ইরাকবাসী এতে পূর্ণ সমর্থন জানায় ও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
যাবের যুদ্ধ
খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন আব্বাসীয়দের প্রতিহত করতে। ১,২০,০০০ সৈন্য সমেত তিনি টাইগ্রিস নদী অতিক্রম করে জাব নদীর তীরে অগ্রসর হন। আব্বাসীয় বাহিনী আবুল আব্বাসের পিতৃব্য আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে সমবেত হয়। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জাব নদীর তীরে কুফ নামক গ্রামে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মারওয়ান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং মসুল, হাররান হয়ে দামেস্কে পলায়ন করেন। সেখান হতে প্যালেস্টাইন হয়ে মিসরের দিকে পলায়ন করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ধৃত এবং নিহত হন। তাঁর মস্তক কুফায় আব্দুল আব্বাসের নিকট প্রেরণ করা। হয়। খলীফা মারওয়ানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উমাইয়া বংশ বিলুপ্ত হয় এবং আব্বাসীয়গণ খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন।
পরিশেষে বলা যায়, ইবনে আব্বাসের বংশধরগণ মহানবী (সাঃ) ও বিবি ফাতিমার বংশধরগণের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার সুযোগ গ্রহণ। করে উমাইয়া বিরোধী প্রচারণা করেন এবং উমাইয়া খিলাফত অবসানে সর্বাত্মক আন্দোলন পরিচালনা করেন। এই আন্দোলন সফলতার পেছনে আবু মুসলিম খোরাসানীর অবদান অপরিমেয়। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাধর, মেধাবী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা। অবশেষে ৭৫০ খ্রি: ২য় জাবের যুদ্ধের মাধ্যমে দামেস্ক কেন্দ্রিক উমাইয়া বংশের পতন ঘটে এবং তদস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসীয় বংশ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions