উমাইয়া খিলাফতের পতনের কারণ
৬৬১ খ্রি. হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এর মাধ্যমে ইসলামিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা লাভ করে রাজতন্ত্রের। তথাপিও তারা তৎকালীন ইসলামি রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণ করতে অনেকাংশেই সক্ষম হন। তারা রাজ্য বিজয়ে যেমন গুরুত্ব দিয়েছিলেন তেমনি তারা ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নানাবিদ কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছিলেন। তবুও তাদের শাসনকাল কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না।
উমাইয়া খিলাফতের পতনের কারণ সমূহ নিম্নে দেয়া হলো :
ইবনে খালদুনের তত্ত্ব :
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালেদুনের মতে যে কোন রাজবংশের স্থিতিকাল একশত বছর। যে কোন রাজবংশই প্রতিষ্ঠা, উৎকর্ষ ও গৌরবের শিখরে আরোহণ, তার ক্রমাগত অবক্ষয় এবং অবশেষে পতন এই ৩ টি অধ্যায়কাল অতিক্রম করে। এই নীতি অনুসারেই মুয়াবিয়া কর্তৃক ৬৬২ খ্রি: প্রতিষ্ঠিত বংশ আব্দুল মালিক ও আল-ওয়ালিদ কর্তৃক চরম শিখরে অবস্থান করে এবং অবশেষে ৭৫০ খ্রি: তার পতন ঘটে।
সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব :
উমাইয়া খলীফাগণ পরবর্তী খলীফা নির্বাচনে কোন সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করতেন না। তাই পরবর্তী খিলাফতের দাবি নিয়ে পিতা-পুত্র ও পিতৃব্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হতো। এর ফলে এই বংশের স্থায়িত্ব ও ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
খলীফাদের অযোগ্যতা ও বিলাসিতা :
কতিপয় খলীফা ব্যতীত যেমন- মুয়াবিয়া, আব্দুল মালিক, আল-ওয়ালিদ, ২য় উমর ব্যতীত প্রায় সকল খলীফাই ছিলেন রাজকার্যে অযোগ্য ও অদূরদর্শী। অপরদিকে অত্যাধিক বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন উমাইয়া বংশের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
চারিত্রিক দুর্বলতা :
খলীফা মুয়াবিয়া (রা.) ও ২য় উমর ব্যতীত প্রায় সকল উমাইয়া খলীফাগণ চারিত্রিক দুর্বলতা প্রদর্শন করেন। মদ্যপান ও হেরেমের প্রতি অত্যাধিক অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের ব্যক্তিগত জীবন কলুষিত হয় এবং জনগণ তাদের নিকট হতে মুখ ফিরিয়ে নেন।
আরব-অনারব বৈষম্য :
উমাইয়া শাসনে অনারব মুসলিম বা মাওয়ালী মুসলিমদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ এর পতনে বহুলাংশে দায়ী ছিল। তাদের উপর অতিরিক্ত করারোপ তাদেরকে উমাইয়া শাসনের বিরোধিতায় উৎসাহ প্রদান করে।
হাশিমীয়দের সাথে দুর্ব্যবহার :
একমাত্র খলীফা দ্বিতীয় উমর ব্যতীত অন্যান্য উমাইয়া খলীফাগণ হযরত আলী (রা.) এর বংশধরদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। জুমুআর জামাআতের খুতবায় হযরত আলী (রা.) এর নামে অপ্রীতিকর বাক্য উচ্চারণ করা হতো। এতে করে অন্যান্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিরুপ মনোভাব পোষণ করে।
খলীফাগণের অধার্মিক কার্যকলাপ :
সাম্রাজ্য-বিস্তার ও সেই সাথে বিপুল ধন সম্পদ প্রাপ্তির ফলে পরবর্তী দুর্বল খলীফাগণ অন্ত:পুর নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ক্রীতদাসীর সাথে অনাচার ও ব্যভিচার তাদের জীবনী শক্তিকে হ্রাস করে দিয়েছিল। আরবীয় রক্তের দূষণ ঘটে। তৃতীয় ইয়াযিদ ও তার পরবর্তী দুজন উত্তরাধিকারী দাসীর পুত্র ছিলেন। শেষের দিকে অনেক খলীফা জুমুআর জামাতে অংশগ্রহণ করতেন না ও পবিত্র রমজানে রোযা পালন করতেন না। এরুপ অনৈতিক ও ধর্মহীন জীবনাচরণে মুসলিম সদ্ৰায় তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে।
নিষ্ঠুরতা :
খলীফা ইয়াযিদের সময়ে সংঘটিত কারবালার হত্যাকাণ্ড, মক্কা ও মদীনায় তাদের ধ্বংসযজ্ঞ, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কঠোরতা ও সুলায়মান কর্তৃক প্রখ্যাত সেনাপতিদের সাথে নির্মম আচরণ উমাইয়া বংশের পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
হিমারীয়-মুদারীয় দ্বন্দ্ব :
উমাইয়া খলীফাগণ নিজ নিজ স্বার্থ রাক্ষার জন্য কখনো হিমারীয়দের উপর আবার কখনো মুদারীয়দের উপর নির্ভর করতেন। তারা এক সম্প্রদায়কে অপর সম্পদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। এতে আরবগণ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে যা উমাইয়া খিলাফতের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
সেনাপতি ও মন্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতা :
দুর্বল উমাইয়া খলীফাগণ নিজেদের বিলাসিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এতে অনেক মন্ত্রী ও সেনাপতি নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজ দায়িত্ব অবহেলা করতেন ও নিজ স্বার্থনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এতে করে উমাইয়া শাসনের অভ্যন্তরে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে এর পতনকে ত্বরান্বিত করে।
খারিজী বিদ্রোহ :
উমাইয়াদের ঘোরতর শত্রু ছিল ও তাদেরকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে। খারিজীদের ক্রমাগত বিদ্রোহ উমাইয়া শাসনের ভিতকে দুর্বল করে দেয়।
শিয়া সম্প্রদায়ের উত্থান :
কারবালার করুণ ঘটনা শিয়া সম্পদায়ের জন্ম দিয়েছিল। হাশিমীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, খলীফাদের বিলাসী জীবন এবং চরিত্রহীনতা ও কুরআন হাদীস হতে বিচ্যুতি শিয়া সম্প্রদায়কে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে সদা তৎপর হতে বাধ্য করেছিল।
আব্বাসীয় আন্দোলন :
বিলাসী জীবন, আমোদ-প্রমোদে অর্থব্যয়ে উমাইয়াদের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। এর সাথে বার্বার, খারিজী বিদ্রোহ, আরব-অনারব দ্বন্দ্ব ও মাওয়ালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ আব্বাসীয় আন্দোলনকে বেগবান করে। শিয়া, খারিজী ও মাওয়ালীরা আব্বাসীয় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিসা পালন করে। অবশেষে এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ৭৫০ খ্রি: ২য় যাবের যুদ্ধে সর্বশেষ খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ানকে পরাজিত করে। এর মাধ্যমে উমাইয়া বংশের চুড়ান্ত পতন ঘটে।
পরিশেষে বলা যায়, ধাপে ধাপে উমাইয়া বংশের পতনের ভিত রচিত হয়। কোন সুনির্দিষ্ট কারণে এই বংশের পতন ঘটেনি, অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ এর পতনের পিছনে দায়ী ছিল। উমাইয়াগণ যে তরবারির জোরে একদিন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, দীর্ঘ ৯০ বছর শাসনের পর তা অন্য নতুন তরবারির জোরেই বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions