Home » » খলিফা হারুন অর রশিদ এর কৃতিত্ব

খলিফা হারুন অর রশিদ এর কৃতিত্ব

খলিফা হারুন অর রশিদ এর কৃতিত্ব

হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকাল ছিল ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ।

কঠোর ও কোমলতার সহাবস্থান আব্বাসীয় খলীফা হারুন-অর-রশীদের চরিত্র ছিল কঠোরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে তৈরি। অন্যায় ও বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি ছিলেন কঠোর, অপরদিকে অসহায় ও সম্বলহীনদের জন্য তাঁর হৃদয় ছিল কোমল। তিনি ছিলেন তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ, উদার, মহানুভব, দানবীর ও বিচক্ষণ নরপতি।

খলীফা হারুন-অর-রশীদ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরও তিনি প্রত্যহ রাত্রিকালে একশত রাকাত নফল সালাত আদায় করতেন। তিনি তাঁর ২৩ বছর শাসনকালে নয় বার হত্ব পালন করেন এবং প্রতিবার একশত জন আলিমকে তার সাথে হত্ব করার জন্য নিয়ে যেতেন। তিনি প্রতিদিন ১০০০ দিরহাম দান করতেন। 

তার পূর্ববর্তী শাসকদের মত তিনিও সন্দেহপরায়ণ ছিলেন। তার ফলে তিনি আলী (রা.) এর বংশধরদের ও বার্মেকী পরিবারের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেন যা তাঁর ব্যক্তিত্বে স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে। 

হারুন-অর-রশীদের কৃতিত্বসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:

স্বর্ণযুগের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা 

খলীফা হারুন-অর-রশীদ ছিলেন আব্বাসী খলীফাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের মধ্যে অন্যতম। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন যে, “নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে জাগতিক কার্যকলাপ নিয়ামক দুটি বিশাল ব্যক্তিত্বশালী নৃপতির নাম দেখা যায়- পাশ্চাত্যে শার্লিমেন, আর প্রাচ্যে হারুন-অর-রশীদ, এর দুজনের মধ্যে নিঃসন্দেহে হারুন অধিকতর শক্তিশালী এবং উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন।”


ন্যায় বিচারক ও প্রজারঞ্জক

খলীফা হারুন-অর-রশীদ ন্যায়বিচারক ও প্রজারঞ্জক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি প্রজাদের অবস্থা দেখার জন্য প্রত্যেক রাত্রিতে ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণ করতেন। তিনি সীমান্ত অঞ্চল ও দুর্গ পরিদর্শন করতেন। তিনি তাঁর কর্মে যত্নশীল ছিলেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি প্রজাদের মঙ্গল সাধন করতেন। 


জনকল্যাণমূলক কাজ

খলীফা হারুন-অর-রশীদ হজ্বযাত্রী ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য বহু স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র ও সরাইখানা নির্মাণ করেন। তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান।

তাঁর স্ত্রী সম্রাজ্ঞী যুবায়দা মক্কায় হাজীদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য নহর-ই-জুবায়দা নামে একটি খাল খনন করেন। খলীফা গরীব ও অসহায় ব্যক্তির জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। 


সমর কুশলী

খলীফা হারুন-অর-রশীদ ছিলেন আব্বাসীয় বংশের একজন শ্রেষ্ঠ সমরবিদ। তাঁর একটি বিশাল ও সুশিক্ষিত সামরিক বাহিনী ছিল, যার তত্ত্বাবধান খলীফা নিজেই করতেন। বিদ্রোহ দমন ও বৈদেশিক শত্রুকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাঁর সামরিক দক্ষতা তিনি প্রমাণ করেন। 


শাসন কাঠামো 

দীর্ঘ তেইশ বৎসর রাজত্বকালে খলীফা আব্বাসীয় খিলাফতের জন্য একটি পরিপূরক শাসন কাঠামো সৃষ্টি করেন। বিখ্যাত বার্মাকী উযির পরিবার ছিল খলীফার শাসন কাঠামোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। 


বাগদাদের ঐশ্বর্য 

খলীফা হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালে বাগদাদ নগরী তৎকালীন বিশ্বে শ্রেষ্ঠ নগরীর মর্যাদা লাভ করে। বাগদাদকে এই সময় অভিহিত করা হত ‘প্রাচ্যের রাণী' বলে। ধন-প্রাচুর্যে, শিল্প-সাহিত্যে, অর্থনীতি-বাণিজ্যে, স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ সকল দিক থেকে বাগদাদ নগরী ছিল অদ্বিতীয়। বাগদাদের বাজার ছিল দেশ-বিদেশের পণ্যে পরিপূর্ণ। বাগদাদের পণ্য ছিল জগৎবিখ্যাত। নৌবন্দর হিসেবে বাগদাদের সুদীর্ঘ পোতাশ্রয় জুড়ে শত শত বাণিজ্য জাহাজ শোভা পেত। বাগদাদের সৌন্দর্য ও আভিজাত্য প্রসংগে P. K. Hitti বলেন, It was then that Baghdad became a city with no peer throughout the whole world'.


জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক 

খলীফা হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা প্রকৃত অর্থে বিস্তার লাভ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ এই সময়ে আব্বাসীয়রা অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাগদাদ নগরী ছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তের জ্ঞানী-গুণীর কর্মস্থল। খলীফা তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। রাজদরবার ছিল তাদের পদচারনায় মুখরিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংগীত, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এই সময়ে শুরু হয়। 

খলীফার প্রচেষ্টায় তাঁর পূর্বসূরী খলীফা আল-মনসুরের অনুবাদ বিভাগ সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়। এই সময় হানাফী মাজহাব আত্মপ্রকাশ করে খলীফার প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফের তত্ত্বাবধানে। ইমাম আল বুখারী (রহ.) হাদীসশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। আবু নুয়াস খলীফার রাজদরবারের একজন স্বনামধন্য কবি ছিলেন। আতিয়া ও আসমায়ী যথাক্রমে কবি ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন। খলীফার তত্ত্বাবধানে গ্রীক দর্শনের আরবী অনুবাদ কর্ম সম্পন্ন হয়। খলীফা ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানী ‘মানকাকে’ বাগদাদে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। এছাড়াও সংগীত ও নৃত্যকলাও খলীফার প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তার সময়ের অন্যতম আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আলিফলায়লা ওয়ালা আরব্য রজনীর উপন্যাস রচনা। 

হানাফী মাযহাবের পৃষ্ঠপোষকতা খলীফা হারুন-অর-রশীদ হানাফী মাযহাবকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। খলীফার প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফ ফিক্হ শাস্ত্রীয় আইন লিপিবদ্ধ করে সুনামের অধিকারী হন। 


কূটনৈতিক সম্পর্ক 

খলীফা হারুন-অর-রশীদ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিখ্যাত একজন নৃপতি ছিলেন। পাশ্চাত্যের অনেক বরেণ্য নরপতির সাথে তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। চীন সম্রাট ফাগফুর ও ফরাসি সম্রাট শার্লিমেনের সাথে খলীফা দূত বিনিময় ও উপহার প্রেরণ করেন।


পরিশেষে বলা যায়, মূলত হারুন-অর-রশীদ ছিলেন আরব্য রজনীর ইতিহাসের নায়ক। তাঁর ঐশ্বর্যশালী বাগদাদ নগরী বিশ্বের কাছে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। শিক্ষা, চিকিৎসা, সংগীত, নাট্যকলা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য হারুন-অর-রশীদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি ছিলেন ধর্মভীরু, প্রজারঞ্জক ও ন্যায়বিচারক নৃপতি। তাঁর সকল সমালােচনার উর্ধ্বে তাঁর কৃতিত্ব ছাপিয়ে যায়। তিনি ছিলেন আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *