খলিফা আল আমিন ও মামুনের গৃহযুদ্ধ
৮০৯ খ্রি: খলীফা হারুন-অর-রশিদের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আল-আল-আমিন খলীফার প্রাসাদে গমন করেন। পরের দিন তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সকল আমীর, উমরাহ, সেনাপতি ও জনসাধারণের কাছ হতে আনুগত্যের শপথ লাভ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আল-মামুন ও আরেক ভাই কাসিম তাদের কর্মস্থল মার্ভ ও কিন্নীসিরিন হতে তাদের আনুগত্য ও উপহার প্রেরণ করেন।
আল-আমিন ও আল-মামুনের চরিত্রগত পার্থক্য
আল-আমিন ছিলেন খাটি আরব বংশদ্ভূত মাতা যুবাইদার পুত্র। অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন একজন পারসিক ক্রীতদাসীর সন্তান। আল-আমিন তাঁর মাতা যুবাইদার ও মাতুল ঈসার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন মাতৃহীন। তিনি উযির জাফর বাৰ্মাকীর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে উভয়েই ছিলেন ভিন্নধর্মী চরিত্রের অধিকারী। আল-আমিন ছিলেন অস্থিরমতি, চঞ্চল-বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ও আমোদপ্রিয়। কিন্তু আল মামুন ছিলেন প্রজ্ঞাবান-বিচক্ষণ, দার্শনিক ও আইনজ্ঞ। তিনি পবিত্র কুরআন কণ্ঠস্থ করেন। এই চরিত্রগত পার্থক্য খলীফা হারুন-অররশীদ ও প্রজাদের নিকট তাঁকে অধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির আসনে বসিয়েছিলেন।
আল-আমিন ও মামুনের মধ্যে গৃহযুদ্ধের কারণ
পিতার ইচ্ছানুযায়ী আল-আমিন বাগদাদের সিংহাসনে বসেন এবং আল-মামুন তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যকার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায় এবং গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।
উত্তরাধিকার নীতির অনুপস্থিতি
খলীফা হারুন-অর-রশীদের একাধিক পুত্র ছিল। তারা সকলেই ছিলেন সিংহাসনের দাবিদার। কিন্তু খলীফা তাঁর প্রিয়তমা পত্নী জুবাইদা ও তাঁর ভ্রাতার চাপে পড়ে তাঁর জৈষ্ঠ্য পুত্র আল-আমিনকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু খলীফা হিসেবে আল-আমিন ছিলেন অযোগ্য যা এই গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
আল-আমিন কর্তৃক মামুনের সেনাবাহিনী ও ধনাগার আত্মসাৎ
মৃত্যুশয্যায় খলীফা হারুন-অর-রশীদ যাকে যে অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ও যার অধীনে যে সম্পদ রয়েছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে অছিয়ত করে যান। ৮০৯ খ্রি: হারুন-অর-রশীদ খোরসান অভিযানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর সঙ্গের ধনাগার ও সেনাবাহিনী মামুনের নামে উইল করে যান। কিন্তু খলীফা হয়ে আল-আমিন গুপ্তচর ও তাঁর উরি ফজল বিন রাবীর মাধ্যমে উক্ত সেনাবাহিনী ও ধনাগার বাগদাদে ফিরিয়ে আনেন। এতে মামুন তার এই অন্যায় আচরণের প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
আল-আমিনের ঈর্ষা
ব্যক্তিগত চরিত্র, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার জন্য আল-মামুন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ও প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় ছিলেন। মামুন প্রাচ্যের প্রদেশসমূহে রাজ কর মওকুফ করে দেন। এতে জনগণের ওপর তিনি প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তাকে প্রাচ্যের প্রজাগণ “তাদের ভগিনীর পুত্র” হিসেবে গ্রহণ করে। এর ফলে মামুনের প্রতি আল-আমিনের ঈর্ষার উদ্রেক হয়। তিনি মামুনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার উপর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠেন।
আরব-পারসিক দ্বন্দ্ব
আব্বাসীয় খিলাফতে এর প্রতিষ্ঠকাল হতে আরব-পারস্য দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। শাসনকার্যে উভয় জাতির লোকদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের সূচনা হয়। আল-আমিনের পরিবার, সমর্থকগণ ও তাঁর অমাত্যবর্গ সকলেই ছিলেন খাটি আরবীয়, অপরদিকে আল-মামুনের মাতা ও সমর্থকগণ ছিলেন পারসিক। তাই নিজ নিজ স্বার্থোদ্ধারে আরব ও পারসিক আমিরগণ এই গৃহযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে তোলে।
আল-আমিনের আমোদপ্রিয়তা ও রাজকর্মে অবহেলা
আল-মামুন তাঁর দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর নিজ প্রদেশের শাসনপ্রণালীতে আত্মনিয়োগ করেন। অপরদিকে আল-আমিন ছিলেন অদূরদর্শী, আমোদপ্রিয়। তিনি তাঁর উরি ফজল বিন রাবীর হাতে সকল রাজকার্য অর্পন করে আমোদ-প্রমোদ ও বিলাস ব্যসনে ডুবে রইলেন। তিনি রাজদরবারকে নর্তকী ও গায়িকার আবাসস্থলে পরিণত করেন।
আল-আমিনের কুশাসন
আল-আমিন তাঁর আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসবহুল জীবনে ব্যাপক অর্থ অপচয় করতে লাগলেন। রাজশাসনের পরিবর্তে আমোদ-প্রমোদে অর্থব্যয়, তাঁর উযীর ফজল বিন রাবীর কুশাসনে সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে আবর্তিত হচ্ছিল। প্রজাসাধারণ এই কুশাসনকে ঘৃণা করতে শুরু করলো।
ফজল বিন রাবীর স্বার্থপরতা
খলীফা আল-আমিনের উযীর ফজল বিন রাবী একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ছিলেন। আল-আমিন ছিলেন দুর্বল চরিত্রের অধিকারী ও রাজশাসনে তার কোন আগ্রহ ছিল না। তাই সকল ক্ষমতা উযীর ফজল বিন রাবীর হাতেই ন্যস্ত ছিল। তাই মামুনকে অপসারণ করে আল-আমিনকে নেপথ্যে থেকে রাজক্ষমতা হস্তগত করার গোপন ষড়যন্ত্রে তিনি লিপ্ত হয়ে ওঠেন।
মামুন ও কাসিমকে অপসারণ
খলীফা হারুন-অর-রশিদের ইচ্ছা অনুযায়ী আল-মামুন ছিলেন খোরসানের ও কাসিম ছিলেন কিন্নীসিরিনের শাসনকর্তা। কিন্তু আল-আমিন তার সমর্থকদের কুমন্ত্রণায় তাঁর উভয় ভ্রাতাকে তাদের পদমর্যাদা হতে বরখাস্ত করেন। মসজিদের | খুতবায় তাদের নাম উচ্চারণে নিষেধ করেন। এতে আল-মামুন আল-আমিনের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
আল-আমিন কর্তৃক চুক্তিপত্রের শর্তভঙ্গ
আল-আমিন তার পিতা কর্তৃক লিখিত চুক্তিপত্রের শর্ত লংঘন করেন। তিনি তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতা মামুনের পরিবর্তে নিজ পুত্র মুসাকে ‘নাতিক বিল হক’ উপাধি দিয়ে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিছুদিন পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্রকেও তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন। কাবাগৃহে রক্ষিত তাঁর পিতার মনোনয়নপত্র তিনি এনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।
মামুনের পুত্রদ্বয়কে হত্যার পরামর্শ
উযীর ফজল বিন রাবী, আল-আমিনকে বাগদাদে বসবাসকারী আল-মামুনের দুই পুত্রকে হত্যার পরামর্শ দেন। তবে আলআমিন এই কথা কানে নেননি।
আল-মামুনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ :
খলীফা আল-আমিন তাঁর উজীরের পরামর্শে আল-মামুনকে প্রদত্ত ১,০০,০০০ দিরহাম ও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এতে করে আল মামুন আল-আমিনের উপর অত্যন্ত ক্রুব্ধ হন।
গৃহযুদ্ধের ঘটনা ও ফলাফল :
সীমান্ত বন্ধ :
যুদ্ধ অনিবার্য বুঝতে পেরে আল-মামুন তাঁর রাজ্যের সীমান্ত বন্ধ করে দিলেন। সেখানে প্রহরী নিযুক্ত করলেন। আল-আমিনের কোন গুপ্তচর যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নযর রাখলেন।
আল-আমিনের সেনাবাহিনীর পরাজয় :
আল-আমিন তাঁর সেনাপতি আলী ইবনে ঈসার নেতৃত্বে ৫০,০০০ সৈন্যের সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ৮১১ খ্রি: রাবী নামক স্থানে মামুনের বিখ্যাত সেনাপতি তাহির ইবনে হুসাইনের নিকট আলী ইবনে ঈসা ও তার সেনাবাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আলী ইবনে ঈসা নিহত হন। এই দু:সংবাদ শুনে খলীফা আল-আমিন তার অপর সেনাপতি আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল প্রেরণ করেন। কিন্তু এই দলটিও তাহিরের নিকট পরাজয় বরণ করে ।
মামুনের খলীফা উপাধি গ্রহণ :
আল-মামুন খলীফা উপাধি গ্রহণ করলেন। আল-আমিনের প্রেরিত বেশ কয়েকটি বাহিনী মামুনের সেনাপতি তাহির ও হারসামার নিকট পরাজয় বরণ করলো। সমগ্র ইরাক ও আরব মামুনের অধীনে চলে আসলো।
বাগদাদ অবরোধ :
মামুনের সেনাপতি তাহির, হারমা ও জুহাইর একত্রে বাগদাদ অবরোধ করেন। বাগদাদে অবস্থান করা নিরাপদ নয় দেখে খলীফা আল-আমিন তাঁর মাতা ও পরিবারবর্গসহ দজলার পশ্চিম তীরে অবস্থিত মদীনাতুল মনসুর দুর্গে আশ্রয় নেন।
আল-আমিনের আত্মসমর্পন :
অবশেষে আল-আমিন বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ সেনাপতি হারসামার নিকট আত্মসমর্পন করেন। কিন্তু রাত্রিকালে কয়েকজন উগ্র পারসিক কর্তৃক হতভাগ্য খলীফা আল-আমিন নিহত হন (৮১৩ খ্রি:)। এই মর্মান্তিক সংবাদে মামুন শোকে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি হত্যাকরীদেরকে তৎক্ষনাৎ শাস্তিবিধান করেন। আল-আমিনের পুত্রদ্বয়কে আলমামুন আপন পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা বড় হলে নিজ নিজ কন্যাগণের সাথে তাদের বিবাহ দেন। মামুন আলআমিনের পরিবারবর্গকে তাদের নিজ নিজ সম্পত্তি ভােগ করার অধিকার দেন।
আল-মামুনের সফলতার কারণ
আল-আমিনের ব্যক্তিগত চরিত্র ও কুশাসন :
আল-আমিনের ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল তাঁর পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী। রাজকার্যে অবহেলা, আমোদ-প্রমোদ ও হেরেমে আত্মনিয়োগ করে তিনি তাঁর চারিত্রিক ত্রুটিগুলোকে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। তাঁর এই শৃঙ্খলহীন জীবনের সুযোগ গ্রহণ করে তাঁর উযীর ফজল বিন রাবী সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন এবং প্রশাসন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন প্রজাহৈষী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নৃপতি। তাঁর শাসনের অধীনে প্রজাগণ সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল। তাই এই চরিত্রগত পার্থক্যের দরুণ আল-আমিনের চেয়ে। প্রজাদের নিকট আল-মামুনের গ্রহনযোগ্যতা বেশি ছিল।
পারসিকদের শ্রেষ্ঠত্ব :
আল-আমিন ও আল-মামুনের দ্বন্দ্ব ছিল মূলত আরব-পারিক দ্বন্দ্ব। ধর্মীয় দিক থেকে এটি ছিল শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব। চারিত্রিক দুর্বলতা ও অনৈতিক ইসলামিক কর্মকাণ্ডের জন্য আল-আমিন খাটি সুন্নী-আরবদের সমর্থন হারান। অপরদিকে শিয়া সম্প্রদায় আল-মামুনকে তাদের ব্যাপক সমর্থন দান করে। তাই আল-আমিনের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী।
আল-আমিনের সমর্থকগণের অযোগ্যতা ও স্বার্থপরতা :
আল-আমিনের উযীর ও সমর্থকগণ অপেক্ষা আল-মামুনের উযীর ও সমর্থকগণ ছিলেন অধিক বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ। মামুনের খোরাসানের সেনাবাহিনী আল-মামুনকে তাদের ‘ভগ্নীরপুত্র’ মনে করতো, অপরদিকে আল- আমিন তার সেনাবাহিনীকে অর্থ দ্বারা বশীভূত করেন এবং তারা ছিল স্বার্থপর ও অবিশ্বস্ত। তাই এই গৃহযুদ্ধে আল-আমিনের পরাজয় ছিল আবশ্যক।
অস্তিত্বের লড়াই :
আল-আমিন আল-মামুনকে সকল দিকে থেকে বঞ্চিত করেন। তাঁর সাথে সকল প্রকার দুর্ব্যবহার করেন। তার সম্পত্তি ও অধিকার হরণ করেন। এমনকি মামুনের পরিবারকেও হুমকির মুখে ফেলে দেন। তাই এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতও ছিল আল-মামুনের নিকট অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। শেষ পর্যন্ত এই মনোবল আল-মামুনকে সফলতা দান করেছিল।
জনসমর্থনের অভাব :
পারস্যবাসী আল-মামুনকে ব্যাপক সমর্থন দান করে। এতে তার মনোবল ও সমর্থন বেড়ে যায়। অপরদিকে আল-আমিনের পেছনে কোন প্রকৃত জনসমর্থন ছিল না। যা তার ব্যর্থতাকে ত্বরান্বিত করেছিল।
অন্যায়ের উপর ন্যায়ের জয় :
এই গৃহযুদ্ধ ছিল মামুনের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। অপরদিকে আল-আমিনের জন্য তা ছিল কেবলই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে টিকে থাকার লড়াই। মূলত এটি ছিল অন্যায়ের উপর ন্যায়ের জয়লাভ ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions