টুরসের যুদ্ধ
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে। এরপর থেকে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনে একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ৭১১ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেনের উমাইয়া শাসনকে বলা হয় পরাধীন উমাইয়া আমীরাত। এ সময়কালের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল টুরসের যুদ্ধ। ইসলাম ও ইউরোপের ইতিহাসে এই যুদ্ধের ফলাফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
টুরসের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট :
আব্দুর রহমান আল গাফিকির শাসনভার লাভ: আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ৭৩২ সালে স্পেনের শাসনভার লাভ করেন। ৭২৫ সাল থেকে ৭৩০ সাল পর্যন্ত স্পেনের শাসনব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হয়। এ সময় ৬ জন শাসনকর্তা সেনাবাহিনী কর্তৃক নিযুক্ত হন। এ অবস্থায় দামেস্কের উমাইয়া খলিফা হিশাম তাকে স্পেনের আমীর হিসেবে নিয়োগ দেন।
অভ্যন্তরীণ বিবাদ দূরীকরণ :
আব্দুর রহমান আল-গাফিকি একজন যোগ্য শাসনকর্তা ও সুদক্ষ সেনাপতি ছিলেন। শাসনক্ষমতা লাভ করে তিনি অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদ দূরীকরণ এবং শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের উপর ন্যর দেন। সে সময় স্পেনের মুসলিমদের মধ্যে গোত্ৰ-কলহে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ আরবের হিমারীয় ও উত্তর আরবের মুদারীয়দের এবং আরবদের সাথে বার্বারদের দ্বন্দ্বে স্পেন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেন। হিমারীয় ও মুদারীয় উভয় গোত্রের মধ্যে তিনি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন এবং তারা তাঁকে তাদের নেতারূপে মেনে নেয়।
শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন :
দেশের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য তিনি সমগ্র দেশ সফর করেন। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন জনপ্রিয় শাসকে পরিণত হন এবং সমগ্র জাতি তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
ইউরোপ জয়ের চেষ্টা :
আব্দুর রহমান আল-গাফিকির মূল লক্ষ্য ছিল তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা। তারিক ও মুসার স্বপ্ন ছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যসহ ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে মুসলিম স্পেনের সাথে একত্রিত করে বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে তােলা। ৭২১ সালে স্পেনের গভর্নর আলসামাহ (৭১৯-২১) পিরেনীজ অতিক্রম করে ফ্রান্সে অভিযান চালান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুলুস-এর যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মুসলিমরা এ পরাজয় ভুলে যায়নি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবস্থা স্থিতিশীল না থাকার কারণে তারা এর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারেনি। ১১ বছর পর আব্দুর রহমান আল-গাফিকির নেতৃত্বে তারা এর সুযোগ পায়।
উসমানকে পরাজিত ও হত্যা :
দক্ষিণ ফ্রান্সের শাসনকর্তা ও বার্বার নেতা উসমান বিন আবু নিসা এ সময় একুইটেনের স্বাধীন শাসক ডিউক ইউডেসের কন্যাকে বিবাহ করে তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
ডিউক ইউডেসের বিরুদ্ধে অভিযান :
৭৩২ সালে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে পিরেনীজ অতিক্রম করে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তিনি আর্লেস নগর দখল করেন। এরপর তিনি একুইটেনের শাসক ডিউক ইউডেসকে পরাজিত করে একে একে বার্তিমাস্ক, বুরন্ডি, লিওন, বেসাসকোন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের আরও কয়েকটি শহর দখল করেন।
টুরসের যুদ্ধের ঘটনা
সে সময় ফ্রান্সে মেরোভিনজিয়ান রাজবংশের (৪৯৬-৭৫১) শাসন চলছিল। এ বংশের শেষ দিকে শাসকরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় প্রাসাদের মেয়র বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তখন রাজা ছিলেন লোথায়ের। তিনি শাসক হিসেবে দুর্বল ছিলেন এবং তার মেয়র ছিলেন চার্লস যিনি প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করতেন। পরে অবশ্য চার্লস রাজা হয়েছিলেন। এদিকে ডিউক ইউডেস তার শত্রু চার্লসের সাথে বিবাদ দূর করে তার সাহায্য কামনা করেন। ৭৩২ সালের অক্টোবর মাসে ইউডেসের সম্মিলিত বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে মুসলিমদের জয়লাভ যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন মুসলিম সেনাদের মধ্যে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তার বাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। যুদ্ধের দশম দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এরপর
টুরসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ :
টুরসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে, সেগুলো নিম্নে দেয়া হলো:
গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা :
চার্লস ও ইউডেসের মধ্যে সন্ধি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দারা কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি খ্রিস্টান সৈন্যদের প্রকৃত শক্তি পরিমাপ করতে পরেননি। তাই এই সন্ধি এবং খ্রিস্টানদের শক্তি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দাদের অজ্ঞতা যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
গোত্রীয় কলহ :
যুদ্ধ চলাকালে মুদারীয়, হিমারীয় ও বার্বারদের মধ্যে পুরাতন গোত্রীয় কোন্দল আবার নতুনভাবে শুরু হয়। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি সাময়িকভাবে বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করলেও তা স্থায়ী হয়নি।
সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থতা:
যুদ্ধের দশ দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির মৃত্যু অবস্থা পাল্টে দেয়। তার মৃত্যুতে মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিনিধি বা সেনাপতি নির্বাচন নিয়ে মুসলিম সেনাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে রাতের অন্ধকারে তারা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।
গনিমতের মাল সংগ্রহে প্রতিযোগিতা :
যুদ্ধে জয়লাভ যখন অত্যাসন্ন তখন মুসলিম সৈন্যরা শৃংখলা ভঙ্গ করে গনীমতের মাল সংগ্রহ করে এবং এই মালের হিফাজতের দিকে দৃষ্টি দেয়। ফলে তারা খ্রিস্টানদের পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কে ভাবা ও এর জন্য নিজেদেরকে সামরিক ও মানসিক দিক দিয়ে যথেষ্ঠ প্রস্তুত করতে পারেনি।
গুজব :
যুদ্ধ চলাকালে গুজব ওঠে যে খ্রিস্টানরা মুসলিম সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করেছে। মুসলিম সেনারা গুজবের যথার্থতা পরীক্ষা না করেই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজেদের স্ত্রী-সন্তান ও সম্পদ রক্ষায় তাঁবুতে ফিরে আসে। ফলে মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং খ্রিস্টানদের আক্রমণ ও জয়লাভ সহজ হয়।
টুরসের যুদ্ধের ফলাফল :
টুরসের যুদ্ধ ইতিহাসের চূড়ান্ত যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম। টুরসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পর চার্লস আহত মুসলিমদের হত্যা করে মার্টেল (Martel) উপাধি লাভ করেন।‘মার্টেল' অর্থ হাতুড়ি (hammer)। হাতুড়ি দিয়ে যেভাবে লোহা বা কঠিন পদার্থকে অবদমিত করা হয় তেমনি ভাবে চার্লস মুসলিমদের পরাজিত করে তাদের বিজয়ের ধারা থামিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মর্যাদাকেও অবনমন করেছেন। আরবের বাইরে এই প্রথম কোন যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যায় বেশি থাকা সত্ত্বেও পরাজিত হল। মুসলিমদের নিকট টুরসের যুদ্ধক্ষেত্র শহীদদের স্মৃতিক্ষেত্র রূপে পরিগণিত। এ যুদ্ধের ফলে খ্রিস্টান ইউরোপে মুসলিমদের প্রবেশ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এই যুদ্ধে চার্লস পরাজয় বরণ করলে সমগ্র ইউরোপের বিপর্যয় ঘটতে পারত। অন্যদিকে P. K. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) এর মতে, এ যুদ্ধে আরবরা জয়লাভ করলে গীবন এবং তার পরবর্তী ঐতিহাসিকরা প্যারিসে এবং লন্ডনের যেখানে এখন গির্জা রয়েছে এর পরিবর্তে সেখানে মসজিদ দেখতে পেতেন এবং অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে বাইবেলের পরিবর্তে কুরআন পাঠ শুনতে পেতেন। Lane Poole (গ্রন্থ: The Moors in Spain) এর মতে, এ যুদ্ধ মুসলিমদের অব্যাহত বিজয়ের ধারা রুদ্ধ করে দেয়। তাঁর মতে, এই যুদ্ধের ফলাফলের উপরই নির্ভর করছিল ইউরোপ খ্রিস্টানদের অধিকারে থাকবে না মুসলিম অধিকারে যাবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions