প্রথম আব্দুর রহমান
৭১১ সাল থকে ৭৫৬ সাল পর্যন্ত স্পেনের উমাইয়া শাসনকে দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনস্ত বা আমীরাতকে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতে পরিণত করেন।
প্রথম আব্দুর রহমানের পরিচয় :
প্রথম আব্দুর রহমান ছিলেন একজন উমাইয়া রাজপুত্র। তিনি উমাইয়া বংশের দশম খলিফা হিশামের দৌহিত্র ছিলেন। স্পেনের ইতিহাসে তিনি ‘আদ্-দাখিল' নামে পরিচিত। আদ্-দাখিল' শব্দের অর্থ প্রবেশকারী বা সূচনাকারী। তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতের সূচনা করায় অথবা পরাধীন উমাইয়া আমীরাত থেকে তিনি স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতের সূচনা করায় তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়। স্পেনের উমাইয়াদের মধ্যে আব্দুর রহমান নামে আরও দুই জন বিখ্যাত শাসক থাকায় ইতিহাসে তিনি প্রথম আব্দুর রহমান নামে পরিচিতি লাভ করেন।
উত্তর আফ্রিকায় আগমন :
৭৫০ সালে জাব নদীর তীরে আব্বাসীয়দের হাতে উমাইয়াদের পতনের পর হিশামের পৌত্র আব্দুর রহমান তাঁর ক্রীতদাস বদরকে নিয়ে প্যালেস্টাইন ও মিসর অতিক্রম করে উত্তর আফ্রিকায় গমন করেন। উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন তখনও আব্বাসীয়দের অধীনতা স্বীকার করেনি। তখন উত্তর আফ্রিকার শাসক ছিলেন আব্দুর রহমান আল-হাবীব আল-ফিহরি এবং স্পেনে তাঁর পুত্র ইউসুফ আল-ফিহরি। আল-ফিহরি এ উমাইয়া উদ্বাস্তু রাজপুত্রকে সাদরে গ্রহণ করেন নি। এমনকি তিনি তাঁকে হত্যারও চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। এরপর তিনি সিউটায় তার মাতুল বার্বার গোত্রের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আফ্রিকায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবেনা ভেবে তিনি স্পেনে গমন ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।
স্পেনে আগমন :
স্পেনে সে সময় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিল যা আব্দুর রহমানের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। আব্দুর রহমান বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্রীতদাস বদরকে গুপ্তচর হিসেবে স্পেনে প্রেরণ করেন। বদর ফিরে এসে সেখানকার অনুকূল অবস্থা বর্ণনা করেন। অন্যদিকে স্পেনের দক্ষিণ আরবীয় বা ইয়ামেনী নেতা আবদুল্লাহ ও উবায়দুল্লাহকে আব্দুর রহমান একটি চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে তারা ইয়ামেনীদের ঐক্যবদ্ধ করে আব্দুর রহমানকে একটি নৌকা পাঠিয়ে স্পেনে আগমনের আমন্ত্রণ জানান। আব্দুর রহমান এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি ৭৫৫ সালে আলমুনেকার বন্দরে অবতরণ করেন। সেখান থেকে এলভিরার মাটিতে পদার্পণ করেন। ইয়ামেনীরা তাঁর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আব্দুর রহমান প্রথমে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই দক্ষিণ দিকের শহরগুলো দখল করলেন। এরপর তিনি কর্ডোভা অভিমূখে যাত্রা করেন।
মাসারার যুদ্ধ ও স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা :
৭৫৬ সালে কর্ডোভার মাসারা নামক স্থানে উত্তর আরবীয়দের সাথে আব্দুর রহমানের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। মাসারার যুদ্ধে আব্দুর রহমান জয়ী হন এবং কর্ডোভা দখল করেন। ফলে দামেস্কের উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতনের ৬ বছর পর স্পেনে উমাইয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। Syed Ameer Ali (গ্রন্থ: A Short History of the Saracens) বলেন,“নির্বাসিত, পলায়নপর, ভবঘুরে এবার তাঁর উচ্চাভিলাষের শিখরে পৌঁছে যান।” এভাবে মাসারার যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন।
ইউসুফ ও সুমায়েলের বিদ্রোহ দমন :
মাসারার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইউসুফ টলেডোতে এবং তার সেনাপতি সুমায়েল জায়েনে পালিয়ে যান। পরে ইউসুফ জায়েনে সুমায়েলের সাথে মিলিত হয়ে বিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ইউসুফ কর্ডোভা দখল করেন। কিন্তু পরে রাজকীয় বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য শক্তির মোকাবেলা করে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত হয়ে অব্দুর রহমানের সাথে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী তার দুইপুত্র আবু জায়িদ ও আবুল আসওয়াদ মুহম্মদকে আব্দুর রহমান যামিন হিসেবে রাখেন এবং ইউসুফ ও সুমায়েল নির্বিঘ্নে তাদের সম্পত্তি ভোগ-দখলে রাখেন। এর ফলে দু’বছর উভয়ের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে। এরপর উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলে ইউসুফ পালিয়ে মেরিদায় গমন করেন এবং ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ৭৫৮ সালে লোকসার যুদ্ধে তিনি আব্দুর রহমানের বাহিনীর হাতে পরাজিত ও আহত হন এবং এর এক বছর পর টলেডোতে তার এক শত্রুর দ্বারা নিহত হন। তার পুত্র আবু জায়িদকে হত্যা করা হয়, আবুল আসওয়াদ বহুদিন কারাবাসের পর পালিয়ে রক্ষা পান। সুমায়েল কারারুদ্ধ হন এবং বিষ প্রয়োগে নিহত হন।
ইয়ামেনীদের বিদ্রোহ দমন :
ক্ষমতা লাভের পর আব্দুর রহমানকে বিভিন্ন আরব গোত্রীয় কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়। ৭৬০ সালে আরজাক বিন নুমান গাচ্ছানি বিদ্রোহ করে সেভিল দখল করেন। রাজকীয় বাহিনী পাঠিয়ে সেভিল উদ্ধার করা হয় এবং আরজাক আত্মসমর্পণ করেন। ইয়ামেনী নেতা ও সেভিলের গভর্নর আবু সাব্বাহ আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে ৭৬৬ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। এতে অন্যান্য ইয়ামেনী নেতাগণ বিদ্রোহী হয়ে অনেক মুদারীয়কে হত্যা করে। ৭৭৪ সালে আমীর তাদের বিদ্রোহ দমন করেন এবং তাদের ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
টলেডোর বিদ্রোহ দমন :
৭৬১ সালে টলেডোর প্রাক্তন শাসনকর্তা হিশাম বিন উরউয়াহ বিদ্রোহ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযান প্রেরণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত ৭৬৪ সালে তিনি আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁকে কর্ডোভায় এনে ফাঁসি দেয়া হয়।
আব্বাসীয় অভিযান প্রতিহত :
আব্দুর রহমান আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নামে খুতবা পাঠ করলেও পরে তা বন্ধ করে দেন। আল-মনসুর স্পেনকে আব্বাসীয় খিলাফতের বলয়ে নিয়ে আসার জন্য কায়রোওয়ানের আব্বাসীয় গভর্নর আলা বিন মুগীসকে ৭৬৩ সালে স্পেনে পাঠান। আলা বিন মুগীস ৭০০০ বার্বার সৈন্যসহ নিহত হন। তাঁর মস্তক ছিন্ন করে আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নিকট প্রেরণ করা হয়। খলিফা আব্দুর রহমানকে ‘সাকর কুরায়িশ’ বা ‘কুরায়িশদের বাজপাখি’ (Falcon of the Quraysh) আখ্যা দেন। দ্রুততম সময়ে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে বাজপাখির সাথে তুলনা করা হয়। এছাড়া আব্দুর রহমানের বীরত্ব ও দক্ষতায় কিছুটা আতঙ্কবোধ করে আল-মনসুর বলেছিলেন,“আমাদের ও এমন এক শত্রুর মধ্যে একটি সমুদ্র (ভূমধ্যসাগর) সৃষ্টির জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ।”
বার্বার বিদ্রোহ দমন :
সান্তাব্রিয়াতে বার্বাররা আবদুল্লাহ্ নামের একজন স্কুল শিক্ষকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে এবং তাদের এই বিদ্রোহ প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয়। ৭৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরিত হলে তিনি জঙ্গলে আত্মগোপণ করেন এবং ৯ বছর পর অর্থাৎ ৭৭৭ সালে তিনি তার ২জন সহচরের হাতে নিহত হন।
শার্লিমেনের অভিযান প্রতিহত :
আব্দুর রহমান যখন দক্ষিণে বিদ্রোহী আরব ও বার্বারদের দমনে ব্যস্ত তখন উত্তর স্পেনের কতিপয় আরব নেতা ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেনের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে স্পেন আক্রমণে প্ররোচনা দেয়। ৭৭৭ সালে শার্লিমেন পিরেনীজ অতিক্রম করে স্পেন আক্রমণ করেন এবং উত্তর স্পেনের কয়েকটি প্রদেশের ধ্বংস সাধন করেন। ৭৭৮ সালে তিনি সারাগোসায় আব্দুর রহমানের বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ফ্রান্সে ফিরে যান।
আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব :
আব্দুর রহমান ৭৮৮ সালে ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩২ বছর স্পেন শাসনকরে উমাইয়া আমীরাতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে ছয়টি প্রদেশে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নরের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি একটি উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শক্রমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে তিনি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। মুদ্রা তৈরির জন্য তিনি কর্ডোভায় একটি টাকশাল নির্মাণ করেন। কর্ডোভার বিশ্ববিখ্যাত মসজিদটি তিনিই নির্মাণ করেন। এ মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা নির্মিত হয়, যা পরবর্তীকালে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তিনি প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন এবং বাগান তৈরি করার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ শখ ছিল। কর্ডোভা নগরীর পশ্চিম দিকে ‘মুন্যাত আল-রুসাফা' নামে একটি বাগান বাড়ি তৈরি করেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সংগ্রহ করে এখানে রোপণ করেন। এখানে পানি সরবরাহের জন্য একটি জলপ্রণালী নির্মাণ করেন। নগরের জনসাধারণও অবশ্য এই জলাধার থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারত। তিনি সুবিচারক ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন। তিনি প্রায়শই প্রজাদের অভাব-অভিযোগ ও কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য বের হতেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা, সু-সাহিত্যিক ও জ্ঞানী-গুণীজনদের পৃষ্ঠপােষক। তিনি মাঝে মাঝে জ্ঞানী-গুণীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সাহিত্য সভার আয়োজন করতেন। ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, ঈসা বিন দিনার, আবু মুসা হাওয়ারী, সাইদ বিন হাসান, ইবনে কায়েস প্রমূখ মনীষীগণ তার দরবার অলংকৃত করেন।
পরিশেষে বলা যায়, খলিফা হিশামের পৌত্র আব্দুর রহমান স্পেনের ইতিহাসে প্রথম আব্দুর রহমান বা আব্দুর রহমান আদ্-দাখিল নামে পরিচিত। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর তাঁর নাম দেন ‘কুরায়েশদের বাজপাখি। ৭৫৬ সালে তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন এবং আব্বাসীয় ও ফ্রান্সের শার্লিমেনের অভিযান প্রতিহত করেন। তিনি ৩২ বছর স্পেন শাসন করে উমাইয়া আমীরাতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions