Home » » প্রথম হিশাম

প্রথম হিশাম

প্রথম হিশাম

আব্দুর রহমান মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হিশামকে (৮৮৮-৯৬) উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। হিশাম ছিলেন হুলাল নামক একজন স্পেনীয় দাসীর গর্ভজাত সন্তান। আব্দুর রহমানের অন্য দুই পুত্র ছিলেন সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ যারা তাঁর সিরীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ছিলেন। হিশামের বুদ্ধিমত্তা ও ধার্মিকতার কারণে দাসীর সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পরবর্তী আমীর হিসেবে মনোনীত করা হয়। পিতার আমলে তিনি মেরিদার গভর্নর ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ৭৮৮ সালে ৩২ বছর বয়সে হিশাম নিজেকে স্পেনের আমীর হিসেবে ঘোষণা করেন। তার শাসনামলে নানা ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং তিনি সবগুলো বিদ্রোহ সফলভাবে মোকাবিলা করেন। 


ভাইদের বিদ্রোহ মোকাবিলা : 

সিংহাসন লাভ করেই তাকে প্রথমেই ভাইদের বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়। পিতা আব্দুর রহমানের জীবদ্দশায় হিশামের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদ্বয় সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ তাঁর মনোনয়নকে সমর্থন করলেও পিতার মৃত্যুর পর হিশাম শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলে তারা বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। ৭৮৯/৯০ সালে তাঁরা টলেডোতে মিলিত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমীর তাঁদের সাথে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে যুদ্ধ হয় এবং সুলাইমান পরাজিত হয়ে মুর্শিয়াতে পলায়ন করেন। আবদুল্লাহও সুলাইমানের পরাজয় এবং কম সৈন্যের কারণে বাধ্য হয়ে হিশামের বশ্যতা স্বীকার করেন। টলেডোর আশেপাশের জায়গা আবদুল্লাহকে জায়গীর দেয়া হয়। সুলায়মান মুর্সিয়াতে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ৭৯০/৯১ সালে হিশামের পুত্র মুয়াবিয়া লোরকায় প্রচণ্ড যুদ্ধের পর চাচা সুলাইমানকে পরাজিত করেন। সুলাইমান ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে ক্ষমা করা হয় এবং স্পেন ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। 


পূর্ব স্পেনে বিদ্রোহ:

হিশাম যখন ভাইদের সাথে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত সেসময় পূর্ব স্পেনে ইয়ামেনীরা বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। ৭৮৮ সালে সাইদ বিন হুসাইন বিন ইয়াহিয়া আল-আনসারীর নেতৃত্বে ইয়ামেনীরা তরতোসাতে বিদ্রোহ শুরু করে। এর ফলে বনু কাসী গোত্রের নও-মুসলিম নেতা মুসা বিন ফরতুনিও-এর নেতৃত্বে মুদারীয়গণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং উমাইয়া শাসনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সাইদ পরাজিত ও নিহত হন এবং তরতোসা মুসার হস্তগত হয়। এ সময় মাতরুহ নামের একজন নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বার্সিলোনায় বিদ্রোহ করে এবং মুসার সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে তরতোসা, সারাগোসা, বার্সিলোনা, তারাগোনা ও হুয়েস্কা দখল করে নেয়। ফলে এ সময় স্পেনে উমাইয়া অস্তিত্ব বিপন্ন হতে যাচ্ছিল। হিশাম তাদের দৃঢ় হস্তে দমনের চেষ্টা করেন। ৭৯১ সালে ভ্যালেন্সিয়ার গভর্নর আবু উসমান উবায়দুল্লাহ্ বিন উসমানকে মাতরুহের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সারাগোসা অবরুদ্ধ হয়। পরে মাতরুহ তাঁর নিজের লোকদের হাতে প্রাণ হারান। ফলে বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ও পরাজিত হয়। মুসা বিন ফরতুনিওকে সারাগোসার গভর্নর নিয়োগ করা হয়।


ফ্রান্স অভিযান : 

অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠার পর হিশাম মুসলিমদের পূর্ব শত্রু ও বিদ্রোহে উৎসাহদানকারী উত্তরের খ্রিস্টান নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৭৯২ সালে আবু উসমানের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী দক্ষিণ ফ্রান্সে অগ্রসর হয়। পরে এই সেনাবাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান করে। একদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মালিক বিন আব্দুল ওয়াহিদ এবং আর একদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল করিম বিন আব্দুল ওয়াহিদ। আব্দুল মালিক বিন আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী নার্বোনে ফ্রাঙ্কদের পরাস্ত করে নার্বোন ও জেরোনা জয় করে। এ সময় ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেন ও তাঁর পুত্র লুইস জার্মানী ও ইতালীতে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। তুলুসের ডিউক উইলিয়াম মুসলিমদের বাধা প্রদান করেন এবং পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। মুসলিমরা সেপ্টিমানিয়া অধিকার করে নেয়। অন্যদিকে আব্দুল করিম বিন আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী গ্যালেসিয়া ও আন্তরিয়া আক্রমণ করে। আরিয়ার রাজা প্রথম বারমুডো ও দ্বিতীয় আলফান্সের সাথে মুসলিম বাহিনীর কয়েকবার মোকাবিলা হয়। শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী তাদের পরাস্ত করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনী ফেরার পথে খ্রিস্টানরা আক্রমণ করে এবং এতে মুসলিমরা পরাজিত হয়। ফলে উত্তর স্পেনে খ্রিস্টানরা আধিপত্য ধরে রাখে এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। 


মালিকী মাযহাবের প্রবর্তন : 

হিশাম ধর্মানুরাগী ছিলেন। তিনি ফুকাহা বা ইসলামী আইন-বেত্তাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক বিন আনাসের ভক্ত ও শিষ্য। ইমাম মালিক ৭১৫ সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। আব্বাসীয় আমলে শিয়া দাবীদার মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহকে সমর্থন করার কারণে আল-মনসুর কর্তৃক তিনি নির্যাতনের শিকার হন। হিশাম তাঁকে স্পেনে আগমন ও বসতি স্থাপন করার অনুরোধ করেন। ইমাম মালিক আব্বাসীয় অত্যাচার সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে রাযী হননি। তদুপরি হিশাম মদীনায় ইমাম মালিকের সাহচর্য এবং তার থেকে জ্ঞান লাভ করার জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। তিনি এ মতবাদ স্পেনে প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চালান। স্পেনে ইমাম মালিকের শিষ্যদের মধ্যে ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া ও ঈসা বিন দিনার ছিলেন উল্লেখযোগ্য।


হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব : 

প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা : 

৮ বছর শাসন করার পর ৭৯৬ সালে ৪০ বছর বয়সে হিশাম প্রাণত্যাগ করেন। হিশামকে উমাইয়া আমীরাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি উমাইয়া রাজ্যকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর তিন পুত্র উমায়িদ আলমালিক, মুয়াবিয়া ও হাকামের সাহায্যে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে সমর্থ হন। 


প্রশাসনিক পদক্ষেপসমূহ : 

তিনি প্রশাসনিক ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনে পরিবর্তন করেন নি এবং পিতার নিযুক্ত উযির ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ পদে বহাল রাখেন। তবে দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ কর্মচারীদের বরখাস্ত করেন। এবং তাদের কখনও পুনঃনিয়োগ দিতেন না। তিনি বেআইনী কর আদায় বন্ধ করে দেন এবং যাকাত ও সাদকাহ্ আদায়ের আদেশ দেন। তিনি সুশিক্ষিত লোকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। 


জনকল্যাণমূলক কাজ : 

তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং গোয়াদালকুইভির নদীর উপর নির্মিত সেতুর সংস্কার সাধন করেন। রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য একটি সুন্দর ঝর্ণা নির্মাণ করেন। এছাড়া তিনি নতুন নতুন প্রাসাদ নির্মাণ ও পুরাতন সরকারী ভবন সংস্কার করেন। কর্ডোভার মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। এর ফলে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬০০ ফুট ও প্রস্থ হয় ২৫০ ফুট। ১২০০ বছর পরও এই মসজিদটির সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয়তা বজায় রয়েছে। তিনি খাল ও পুকুর খনন করেন। তিনি দরিদ্রদের অর্থ বিতরণ করতেন। 


ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতা : 

চরিত্রের দিক দিয়ে তাঁকে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় উমরের (উমর বিন আব্দুল আযীয) সাথে তুলনা করা হয়। কারণ তিনি দ্বিতীয় উমরের মতই ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। দ্বিতীয় উমরের মত তিনিও তার গোপন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অবস্থা দর্শন এবং প্রাদেশিক গভর্নর ও সরকারী কর্মকর্তাদের যোগ্যতা নিরূপণ ও তাদের কাজ-কর্মের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন অথবা তাদের চাকুরী হতে বরখাস্ত করতেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন। আরবী শিক্ষার জন্য অনেক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন।


কাব্যপ্রীতি : 

কাব্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল এবং তিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন। আমর বিন আলী গাফফার তাঁর দরবারের বিখ্যাত কবি ছিলেন।


পরিশেষে বলা যায়, প্রথম হিশাম সিংহাসন লাভ করে তার দুই ভাই সুলাইমান ও আবদুল্লাহর বিদ্রোহ এবং ইয়ামেনীদের বিদ্রোহ সফলভাবে মোকাবিলা করেন। তিনি ফ্রান্সে অভিযান চালিয়ে সেপ্টিমানিয়া অধিকার করে নেন। হিশাম স্পেনে মালিকী মাযহাব প্রবর্তন করেন। তাঁকে উমাইয়া আমীরাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা' বলা হয়। ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে তাঁকে দ্বিতীয় উমরের (উমর বিন আব্দুল আযীয) সাথেও তুলনা করা হয়।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *