সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামের ষোলশহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর মা মারা যান। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতার বিভিন্ন কর্মস্থলে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত হয়।
তিনি ১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪১ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ, আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও তা শেষ করতে পারেননি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এমএ ডিগ্রি নেওয়ার আগেই ১৯৪৫ সালে তিনি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দি স্টেটম্যান’ এর সাংবাদিক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকার সাব-এডিটর ছিলেন। তখন থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’, ‘পরিচয়', 'অরণি’, ‘পূর্বাশা’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ঢাকায় এসে বেতার কেন্দ্রে সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫০ সালে তিনি করাচি বেতারের বার্তা সম্পাদক হন এবং তারপর তিনি কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের চাকরি ত্যাগ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ফরাসি নাগরিক এ্যান মেরির সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন আত্মমুখী, নিঃসঙ্গ এবং অতিমাত্রায় সলজ্জ ও সঙ্কোচপরায়ণ একজন ব্যক্তি। তার চরিত্রের আভিজাত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো ব্যাপক অনুশীলন, অধ্যয়নস্পৃহা ও কল্পনাপ্রিয়তা। তার আরেকটি বিশেষ গুণ ছিলো যে তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। তিনি গল্প এবং উপন্যাসে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বহির্লোক এবং অন্তর্লোকের যে সূক্ষ্ম ও গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মবিশ্বাসে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত, আশাহীন ও মৃতপ্রায় সমাজজীবনের চিত্র যেমন এঁকেছেন, তেমনি তিনি মানুষের মনের ভেতরকার লোভ, প্রতারণা, ভীতি, ঈর্ষা প্রভৃতি প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানীর মতোই উদ্ঘাটন করেছেন।
শুধু উপভোগ্য মজাদার গল্প রচনা তার অভীষ্ট ছিল না। তিনি মানব জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলোকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। এটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ-উপন্যাসে তিনি গ্রাম-বাংলার সমাজ-জীবনের এক ধ্রুপদী জীবনধারাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর অন্য দুটি উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪) ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)-তে চেতনা-প্রবাহ রীতি ও অস্তিত্ববাদের ধারণাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘নয়ন চারা’ ও ‘দুই তীর’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৪৬ ও ১৯৬৫ সালে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নিরীক্ষামূলক তিনখানি নাটকও লিখেছেন। সেগুলো হল ‘বহিপীর’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’ ও ‘সুড়ঙ্গ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবরে তিনি প্যারিসে পরলোক গমন করেন এবং প্যারিসেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions