Home » » চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল

পজমিদারগণ জমির স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব লাভ করে। তারা ক্ষেত্রবিশেষে জমির উন্নতি বিধানের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে। এর ফলে জমির উৎপাদন শক্তি ও মূল্য বেড়ে যায়। সরকার প্রতিবৎসর নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়-সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিল। ফলে নতুন জমিদারশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন প্রভাবশালী জমিদারগণ ইংরেজ সরকারের নানা কাজে সহায়তা করে। পাশাপাশি তাদের প্রভাবে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। এর পর থেকে অনেকটা লোক দেখানো হলেও বাংলার সামাজিক ও বৈষয়িক উন্নতি সাধনেও বিশেষভাবে মনোযোগ দেয় তারা। বিত্তবান জমিদারগণ নিজের সুনাম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্কুল, কলেজ ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করে। পাশাপাশি তারা অনেক জলাশয় ও দীঘি খনন করে। বেশকিছু রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং পালা পার্বন ও সামাজিক উৎসবে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে দেখা যায় জমিদারদের। অন্যদিকে বাংলার গ্রামীন জীবন সচল হয়ে উঠতে দেখা যায় নানা আয়োজনে। 

এ সময়েই জমিদার শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণির মধ্যে সংযোগের মাধ্যমরূপে কৃষিজমির উপ-স্বত্বভোগী এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই শ্রেণি ব্রিটিশদের রাজ্য শাসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। আয় সুনিশ্চিত হওয়াতে কোম্পানির বার্ষিক বাজেট প্রণয়ণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুবিধা হয়। অস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদ্ভূত কুফলগুলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা দূর করা সম্ভব হয়েছিল।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল

প্রথমত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সঠিক জরিপের মাধ্যমে জমি ভাগ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে নিষ্কর জমির উপর বেশি পরিমাণ রাজস্ব নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি জমির সীমানা নির্ধারিত ছিল না। ফলে পরবর্তীকালে মামলা মোকদ্দমার সৃষ্টি হতে থাকে যা পুরো ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়। এই ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীকালে জমির মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে তার ফলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি হয়নি। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হলেও সরকার বর্ধিতাংশ থেকে বঞ্চিত হয়। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দরুণ প্রজা ও কৃষকদের কোন উন্নতি হয়নি। জমিতে প্রজাদের পুরাতন স্বত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়। এতে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে তারা জমিদারদের করুণার উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। জমিদার ইচ্ছা করলে যে কোন সময় তাকে উচ্ছেদ করতে পারতেন। পরিশ্রম করেও কৃষকগণ যথাযথ পারিশ্রমিক না পাওয়ায় চরম দুর্দশার মধ্যে পতিত হয়। 

সূর্যাস্ত আইনের কঠোরতার জন্য অনেক বড় বড় জমিদারী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে বর্ধমানের, নাটোরের, দিনাজপুরের, নদীয়ার, বীরভূমের ও বিষ্ণুপুরের জমিদারী ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এঁদের মধ্যে একমাত্র বর্ধমানের জমিদারী ছাড়া আর অন্য সব জমিদারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম সাত বছরের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের স্থলে ফড়িয়ারা জমিদার হয়ে এসে রায়তদের উপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

জমিদারীর স্বত্ব ও আয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নায়েব গোমস্তাদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে জমিদারগণ গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস শুরু করে। শহরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে বটে গ্রাস ধারণ করে বিবর্ণরূপ। ফলে গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকে। 

জমিতে অর্থ বিনিয়োগ করে অনায়াসে সম্পদ ও মর্যাদা লাভের আশায় শিল্প-বাণিজ্য পরিত্যক্ত হতে থাকে। ফলে গ্রাম বাংলার কুটির শিল্প ও শ্রম শিল্প ক্রমশ ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বেশিরভাগ মানুষ তখন জমিদারির দিকে ঝুঁকে পড়ায় শেষ পর্যন্ত কৃষি এবং শিল্প প্রায় বিপন্নের দিকে মোড় নেয়। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল মুসলিম সম্প্রদায়। উইলিয়াম হান্টারের মতে, “গত পঁচাত্তর বছরের মধ্যে বাংলার মুসলমান পরিবারগুলোর অস্তিত্ব হয় পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে, না হয় ইংরেজদের সৃষ্ট নতুন ধনী সমাজের নীচে এ সময় ঢাকা পড়েছে।” এর মাধ্যমে একটি বিশেষ শ্রেণি তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। বন্দোবস্তের পর বিভিন্ন জমিদারের নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলে লর্ড ক্যানিং ১৮৫৯ সালে রাজস্ব আইন দ্বারা খাজনা বৃদ্ধি বন্ধ করেন। 

১৮৮৫ সালে প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা জমি থেকে উচ্ছেদ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ভারত-পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উঠিয়ে দিয়ে প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি জমির বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

0মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল*

বার্তা*