বাংলাদেশের কৃষি কাঠামো
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবস্থান ও গুরুত্ব, উৎপাদনের উদ্দেশ্য, ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা, খামারের আয়তন, ব্যবস্থা, কৃষির বিভিন্ন উপখাতের তুলনামূলক গুরুত্ব ইত্যাদি দিয়ে গঠিত কৃষি খাতের সার্বিক অবস্থাকে বাংলাদেশের কৃষি কাঠামো বুঝায়। প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং অর্থনীতির উন্নয়ন স্তর কৃষি কাঠামোকে প্রভাবিত করে বলে দেশভেদে এর প্রকৃতি ভিন্ন হয়।
নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতির কৃষি কাঠামো আলোচনা করা হলো:
১. ভূমি কর্ষণ: বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক নিজের জমি চাষ করে। এ ধরনের মালিক চাষীর দ্বারা আমাদের মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ কর্ষিত হয়। এ ছাড়া আছে বর্গাচাষী যারা নির্দিষ্ট শর্তে অন্যের জমি চাষ করে। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ আবাদি জমি বর্গা চাষের অধীনে রয়েছে। আবার অনেক সময় ঋণের প্রয়োজনে জমির মালিক জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহন করে। এরূপ ক্ষেত্রে ঋণদাতা ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত জমিচাষ করতে থাকে । আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষক একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পূর্ব নির্ধারিত অর্থ কিংবা ফসলের বিনিময়ে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করে ।
২. চাষ পদ্ধতি: আমাদের দেশে এখনও পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতির প্রাধান্য রয়েছে। আমাদের কৃষক এখনও লাঙল গরুর সাহায্যে জমি চাষ করে । উন্নত জাতের বীজ ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কম। তবে বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল বীজ প্রচলিত হওয়ায় আমাদের কৃষির আধুনিকীকরণের যাত্রা শুরু হয়েছে।
৩. জমি-জনসংখ্যা অনুপাত: কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার জন্য বাংলাদেশে জমি-জনসংখ্যা অনুপাত (land - man ratto) অত্যন্ত নিম্ন। দেশের প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং কৃষিই তাদের প্রধান উপজীবিকা। ফলে পরিবারের সকলেই ক্ষুদ্রায়তন পৈত্রিক জমি চাষ করে। বিকল্প নিয়োগের অভাবে আমাদের কৃষিতে বহু অপ্রয়োজনীয় শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। ফলে জমিতে নিয়োজিত শ্রমিকের কিছু অংশের প্রান্তিক উপাদান শূন্য। তাই আমাদের কৃষিতে ছদ্মবেশী বেকারত্বের প্রকোপ খুব বেশি।
৪. খামার ব্যবস্থা: বাংলাদেশে জীবন ধারণোপযোগী খামার ব্যবস্থা (Subsistence farming) প্রচলিত রয়েছে। জীবন ধারনোপযোগী খামারে পরিবারে ভরণ-পোষণের জন্য যে বিভিন্ন ফসলের প্রয়োজন হয় সম্ভব হলে তা প্রায় সকলই একই খামারে উৎপাদন করার চেষ্টা করা হয়। এদেশে এখনও বানিজ্যিক খামার ব্যবস্থা (Commercial farming) প্রসার লাভ করে নি 1
৫. খামারের আয়তন: আয়তন অনুযায়ী বাংলাদেশের কৃষি খামারগুলোকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ০.০৫- ০.৪৯ একরের খামার গুলো প্রান্তিক খামার, ০.৫০-২.৪৯ একরের খামারগুলো ক্ষুদ্রায়তন খামার, ২.৫০-৭.৪৯ একর আয়তনের খামারগুলো মাঝারি এবং ৭.৫০ একর হতে আরো বড় আকারের খামারগুলো বৃহদায়তন খামারের অন্তর্ভুক্ত।
৬. ভূমি বন্টন: বাংলাদেশের ভূমিবন্টন ব্যবস্থায় প্রচন্ড বৈষম্য রয়েছে। ২০০৫ সালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে দারিদ্র্য পরিমাপে দেখা যায় যে, দেশের প্রায় ৪৬.৩ শতাংশ জনগনই ভূমিহীন। আবার সামান্য হলেও জমি আছে এমন কৃষি খামারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিচালিত Agriculture sample survey of Bangladesh 2005 পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, দেশের ৬২.১৭ শতাংশ খামারের আয়তন এক একরের নিচে। অর্থাৎ এ সকল খামারের মালিকরা সকলেই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী। উপরের পরিসংখ্যান হতে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণই ভূমিহীন। আবার যাদের ভূমি আছে তাদেরও অধিকাংশ নগণ্য পরিমাণ জমির মালিক।
৭. কৃষি পণ্যের ধরণ: বাংলাদেশের কৃষিতে দু ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়,যথা: (ক) খাদ্য শস্য এবং (খ) অর্থকরী ফসল ধান, গম, ভূট্টা, ডাল, তৈলবীজ, শাক-সবজি, ফলমূল প্রভৃতি প্রধান খাদ্যশস্য। অন্যদিকে অর্থকরী ফসলের মধ্যে রয়েছে পাঠ, ইক্ষু, রেশম, তুলা, ইত্যাদি। তাছাড়া কৃষক তার বাড়ির আঙ্গিনায় গরু, মহিষ, হাঁস-মুরগি পালন করে। তাবে বানিজ্যিক ভিত্তিতে পশু পালন ও হাঁস-মুরগির খামারের সংখ্যা এখনও খুবই কম ।
৮. জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান: কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত। দেশের শ্রম শক্তির প্রায় ৪৯ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত রয়েছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদনের (জি.ডি.পি) মৎস্য খাতসহকৃষি খাতের অবদান ছিল ১৬.০০ শতাংশ। কৃষি উৎপাদনের উপর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার নির্ভর করে। ফসল ভাল হলে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে এবং শস্যহানিতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাসপায় ।
৯. কৃষির উপখাত: পূর্বে কৃষির বিভিন্ন উপখাত হিসেবে শস্য/ফসল,মৎস্য, পশু, ও বনজসম্পদকে বিবেচনা করা হতো। বর্তমানে কৃষির উপখাত হলো শস্য ও শাকসবজি, প্রাণি সম্পদ এবং বনজ সম্পদ। মৎস্য সম্পদ বর্তমানে উন্নত কৃষি খাত ৷
১০. খাদ্যশস্য উৎপাদন : আশির দশকের প্রারম্ভে (১৯৮০/৮১) চালের উৎপাদন ছিল প্রায় ১৩৯ লক্ষ মেট্রিক টন। এখন বিভিন্ন কারণে আবাদযোগ্য জমির পরমান হ্রাস পেলেও এ উৎপাদন ২০১৪/১৫ সালে দাঁড়ায় ৩৮৪.১৯ লক্ষ মেট্রিক টন। এসময় গম ১৩.৪৮ ও ভূট্টা ২৩.৬১ লক্ষ মে. টন উৎপাদন হয়েছে।
১১. খাদ্যশস্য আমদানি: ১৯৯৫/৯৬ সালে মোট খাদ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ২৪.২৭ লক্ষ মে. টন। ২০১৩/১৪ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৩১.২৪ লক্ষ মে. টন (চাল ৩.৭৪ লক্ষ মে.টন এবং গম ২৭.৫০ লক্ষ মে. টন)। জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলেও অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে আমদানির পরিমান সে হারে বাড়েনি।
১২. বীজ উৎপাদন: বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) সারা দেশে ২৪ টি দানা শস্য বীজ উৎপাদন খামার, ২টি পাট বীজ উৎপাদন খামার, ২টি আলু বীজ উৎপাদন খামার,৩টি ডাল ও তৈল বীজ উৎপাদন খামার,২টি সবজি বীজ উৎপাদন খামার, ও ৭৩টি চুক্তিবদ্ধ চাষি জোনের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া, ৯টি উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্র ও ১৪টি এগ্রো সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে উৎপাদিত বিভিন্ন ফসলের চারা, কলম, গুট ইত্যাদি উৎপাদন ও চাষি পর্যায়ে বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
১৩. সেচ: বৈশ্বিক উষ্ণায়ন,জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক নদীতে পানি প্রবাহ হ্রাস ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে ভূ- গর্ভস্থ পানির চাপ কমানোর লক্ষ্যে এবং ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারে অপচয় হ্রাসের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেচকৃত জমির পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৪-০৫ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেচভূক্ত এলাকা ছিল যথাক্রমে ৪৬.৫২ ও ৫৪.৪৮ লক্ষ হেক্টর।
১৪. কৃষি ঋণ: দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার তথা সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কৃষিখাত এবং পল্লী অঞ্চলের ভূমিকা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে কৃষি ঋণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০০১-০২ বিতরণ অর্থবছরে কৃষিঋণ করা হযেছে ৩০১৯.৬৭ কোটি টাকা যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ১৫,৯৭৮.৪৬ কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হয়।
১৫. সরকারের অংশগ্রহন: বাংলাদেশে কৃষিকাজ সম্পূর্ণরূপে বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত হলেও এক্ষেত্রে সরকারের সক্রিয় সহযোগীতা রয়েছে। কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে করে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে আধুনিকীকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে সরকারি অংশগ্রহন গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র সেচ সম্প্রসারণ, জলাবদ্ধতা নিরসন,উন্নতমানের ও উচ্চফলনশীল বীজ উৎপাদন,সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে। পরমানু ও বায়োটেকনোলজি পদ্ধতি ব্যবহার করে কীট-পতঙ্গ ও রোগ বালাই মুক্ত, খরা লবণাক্ততা সহিষ্ণু,আবহাওয়া পরিবেশ উপযোগী এবং স্বল্প সময়ে ফসল পাওয়া যায় এ লক্ষ্যে বিভিন্ন শস্যবীজের উপর গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions