বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাঙালির দুই যুগ দীর্ঘ সংগ্রামের সর্বাগ্রে গণ্য নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুগের পর যুগ বাঙালির লড়াই সংগ্রাম পরিণতি পায় বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বের মাধ্যমে। তিনি স্কুল ছাত্র থাকা অবস্থায় জনহিতকর ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। তরুন বয়সেই বঙ্গবন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশের তুখোড় রাজনৈতিক নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর যোগ্য রাজনৈতিক শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন।
ভারত ভাগ হবার পর শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করায় তাঁকে ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরোধী তথা বাঙালির স্বাধিকারের লড়াইয়ে শেখ মুজিব অগ্রসৈনিক। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন শেষ বিচারে বঙ্গবন্ধু অমোঘ নেতৃত্বের পরিচয় বহন করেন। নির্বাচনে জয় লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার ঘৃন্য ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। এই অসহযোগ ছিল মূলত পাকিস্তানের মৃত্যু পরোয়ানা । ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যাবতীয় সঙ্কেত প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু। অতঃপর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কন্ঠ থেকে নি:সৃত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বৃত্তান্ত
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সনের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল পথ চলতে বাধা-বিপত্তিতে পড়লে তিনি কখনো তা এড়িয়ে চলেননি; বরং সাহসিকতার সঙ্গে তার মোকাবেলা করেছেন। ১৯৪৭ সালে কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করার পর একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। শেখ মুজিব ছিলেন আজীবন রাজনীতিক। রাজনৈতিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শেরেবাংলা এ কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পুরোধা রাজনীতিবিদদের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এ ছাড়া নেতাজী সুভাষ বসুর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়াস বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে দৃশ্যত সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতকের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন।
বিদেশে অবস্থান করছিলেন বিধায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যার দৃশ্যপটে বিপদগামী সেনাসদস্যরা থাকলেও, এ কথা আজ প্রতিষ্ঠিত যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ছিল সর্বোতোভাবে একটি দেশি-বিদেশী চক্রান্তের ফল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মকান্ড
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়, তিনি মনে প্রাণে ছিলেন একজন উদারনৈতিক মুক্তিকামী মানুষ। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড পুরোটা জুড়ে ছিল বাংলার গণমানুষের মুক্তি। নিম্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরও কিছু রাজনৈতিক চিন্তা তুলে ধরা হল-
পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকলেও, সাম্প্রদায়িক ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে' বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস ছিল। তাই পাকিস্তানের জন্মের অল্প সময় পর থেকেই তিনি অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতে শুরু করেন।
• পাকিস্তানের একেবারে সূচনা পর্বেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের ন্যায্য হিস্যা কখনোই বুঝিয়ে দেবে না ।
• দল ও দলের বাইরে বিরোধীতা স্বত্ত্বেও ১৯৬৬ সালে ছয় দফা উত্থাপনের দূরদর্শিতা দেখান বঙ্গবন্ধু। ছয় দফা পরবর্তীতে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
• ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা পর্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপে সর্বোচ্চ মাত্রার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি কখনোই বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামকে তথাকথিত বিচ্ছিনতাবাদের তকমার মধ্যে আটক হতে দিতে চাননি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে, ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল প্রকাশিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাগাজিন নিউজউইক এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স' অর্থাৎ ‘রাজনীতির কবি' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
স্বাধীনতার পরে জাতি গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য একের পর এক আদর্শিক ও বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। দেশের ভেতরে নানামুখী শক্তির অরাজকতা ও বিদেশী চক্রান্তের পরিণতিতে একের পর এক বাধাগ্রস্ত হলেও, আমৃত্যু বাংলার মানুষের মুক্তির লড়াই চালিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions