দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ
অনেকগুলো পরস্পরবিরোধী কারণ সামনে রেখেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো কারণকে এক এবং একমাত্র বলে দায়ী করা যায় না। এর পেছনে দীর্ঘমেয়াদে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তার মধ্যে তিনটি ঘটনা সবার আগে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯২০ সালের দিকে ইতালির ফ্যাসিজম, ১৯২০ সালের দিকে জাপানি সামরিকবাদের বিকাশ এবং ঠিক তার এক দশকের মাথায় ১৯৩০ সালে চীন আক্রমণকে এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে। পাশাপাশি ১৯৩৩ সালে এসে জার্মানিতে উদ্ভব ঘটে কুশলী রাষ্ট্রনায়ক হিটলারের। যাকে বিশ্বের বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ ঘৃণ্যতম স্বৈরতান্ত্রিক শাসক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। তবে ইতিহাসের বাস্তবতায় হিটলার ছিলেন একটি উপলক্ষ মাত্র, যিনি ১৯৩৩ সালের দিকে নাৎসি পার্টির নেতা হিসেবে জার্মানির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি ভার্সাই চুক্তির অপমানজনক শর্তগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে জার্মানিকে নতুন উদ্যমে মাথা তুলে দাঁড়াতে প্রণোদিত করেন ।
১৯৩৯ সালে জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিলিতভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানির বিরুদ্ধে । এক্ষেত্রে বিদ্যমান কারণগুলোকে দার্শনিক, অর্থনীতি সম্পর্কিত ও বিশেষ কয়েকটি দিক বিচারে আলাদা করা যেতে পারে। যেমন মতাদর্শ, শাসনকাঠামো কিংবা দার্শনিক দিক থেকে চারটি কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তা হচ্ছে সমাজতন্ত্রবিরোধী মতবাদ (Anti-communism), সম্প্রসারণবাদ (Expansionism), সামরিকবাদ (Militarism) ও বর্ণবাদ (Racism)। অন্যদিকে ভার্সাই চুক্তি একটি ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। ভার্সাই চুক্তির প্রতি পরবর্তীকালে জার্মানির দৃষ্টিভঙ্গি, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাজার দখলের লড়াই, লীগ অব নেশন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা, ম্যাসন-ওভেরি তত্ত্ব (The Mason-Overy Debate) যা যুদ্ধের প্রতি ইউরোপীয় দেশগুলোকে প্রণোদিত করে। এর পাশাপাশি আরো কিছু সরাসরি কারণ ছিল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে প্রণোদিত করে ।
সরাসরি বলতে গেলে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর নেতা হিটলারের ক্ষমতায় আরোহণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ, রাইনল্যান্ডে সেনা সমাবেশ, ইথিওপিয়ায় ইতালির আক্রমণ এর সবকিছুই আরেকদফা মহাযুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করে বিশ্বকে। পাশাপাশি প্যান জার্মানিজমকে সামনে রেখে তৈরি মতবাদ ( Anschluss), মিউনিখ চুক্তি, সোভিয়েত- জাপান সীমান্ত বিরোধ, ডানজিগ সংকট, মিত্র পক্ষের সাথে পোল্যান্ডের সংযুক্তি উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালে। অন্যদিকে মলটোভ-রিবেনট্রপ সংকট আরো তীব্রতা পেয়েছে ততদিনে। ধীরে ধীরে ক্ষমতা ও প্রভাববলয় বাড়িয়ে তোলা জার্মানি এবার আক্রমণ করে বসে পোল্যান্ডে। শক্তিশালী সোভিয়েট ইউনিয়নের ভূমিকা এতদিনে আগ্রাসী রূপ লাভ করে। ঠিক তেমনি মুহূর্তে জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ আরেকদফা যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করে বিশ্বকে।
সমাজতন্ত্রবিরোধী মতবাদ (Anti-communism )
১৯১৭ সালে রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় আসে বলশেভিক দল। এই দলের নেতারা সমাজতন্ত্রকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে চেষ্টা করেন। যে বিপ্লব রাশিয়ায় সফল হয়ে জার ক্ষমতার পতন ঘটিয়ে শ্রমিক দলকে ক্ষমতায় বসাতে পেরেছিল। তারা চেয়েছিলেন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে যাক এই মতবাদ। বিশ্বের অন্যদেশ তাদের এই মনোভাব ভালোভাবে নিতে পারেনি অন্যদিকে বিশ্বের যে দেশেই অনেকটা বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাশিয়া সেখানে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে। তারা বিপ্লবী জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র থেকে শুরু করে আর্থিক সহায়তা দিতে কার্পণ্য করেনি। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাশিয়াবিরোধী অবস্থান তুঙ্গে ওঠে। রাষ্ট্রগুলো চেয়েছিল যেভাবেই হোক রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে, অন্তত সেটা করা সম্ভব না হলে রাশিয়ার দেখাদেখি তাদের দেশেও জনগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া যদি বিদ্রোহী জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, তাদের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দেখা দেবে। বিষয়গুলোকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে সমাজতন্ত্রবিরোধী মতবাদ। এ মতবাদ অনেকগুলো সাম্রাজ্যবাদী দেশকে একই পতাকার নিচে একত্রিত হওয়ার পথ করে দেয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ।
সম্প্রসারণবাদ (Expansionism) : একটি নির্দিষ্ট স্থানভিত্তিক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টাকে সম্প্রসারণবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ইতালির শাসন ক্ষমতায় এসে বেনিতো মুসোলিনি চেষ্টা করেছিলেন নতুন করে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। এক্ষেত্রে পূর্বে রোমানদের অধীন দেশগুলোতে ইতালির আগ্রাসন সম্ভাব্য হয়ে দেখা দেয়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে তারা ১৯৩৯ সালে আলবেনিয়া আক্রমণ করে, গ্রিসের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি ১৯৩৫ সালে ইথিওপিয়া আক্রমণ করে বসে। এ বিষয়গুলো লীগ অব নেশনসের নীতিমালাবহির্ভূত কাজ। এমনি আগ্রাসী চিন্তা দ্রুতই একটি বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করে যা জার্মানির সরাসরি ভূমিকায় বাস্তব রূপ লাভ করে ।
সামরিকবাদ (Militarism) : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুদ্ধ শুরুর বেশ আগে থেকেই সশস্ত্র শান্তির যুগে একের পর এক বিস্তৃত হতে থাকে সামরিকবাদ। প্রতিটি দেশ আর্থিক দৈন্য উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ করে তোলে সামরিক বাহিনীর আকার। এক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের সেনাবাহিনীর ট্রেনিং নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর এক দশক আগে থেকে অনেকগুলো দেশে সামরিক বাহিনীর আকার বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সমরসজ্জা বাড়িয়ে তুলতে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর এই আকৃতিগত সম্প্রসারণ তাদের নতুন করে আরেকটি যুদ্ধে জড়িত হতে প্রণোদনা দেয়।
বর্ণবাদ (Racism)
জার্মানি ও ইতালির একত্রীকরণ ইউরোপে রাজনীতির প্রেক্ষাপট পাল্টে দেয়। তারা প্রথমে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হয়, পরে আত্মপ্রকাশ করে উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে। শেষ পর্যন্ত প্যান জার্মানিজম মতবাদের আওতায় তারা প্রকাশ ঘটাতে থাকে নানা ন্যক্কারজনক চিন্তা চেতনার। এদিকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালির মত দেশগুলোও বর্ণবাদী চিন্তায় পিছিয়ে থাকেনি। পাশাপাশি সোশ্যাল ডারউইনিজমের চিন্তা একবার বিস্তৃতির সুযোগ হলে তা ছড়িয়ে পড়ে বেশ দ্রুত। এর প্রভাবে প্যান শ্লাভিজম, প্যান ইতালিজম, প্যান জার্মানিজম প্রভৃতি চিন্তাকে উসকে দেয়। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের মত বিষয়গুলো এ মতবাদকে প্রণোদিত করে। ধীরে ধীরে অভিবাসন অঞ্চল ধরে রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা পেয়ে বসলে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে।
ভার্সাই চুক্তির দুর্বলতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ভার্সাই চুক্তির দুর্বলতা ও জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেয়া ফ্রান্সের প্রতিশোধপরায়ন শর্তগুলো। এ চুক্তি এমনভাবে দাঁড় করানো হয় যে যেকোনোভাবে জার্মানি যাতে ঘুড়ে দাঁড়াতে না পারে। শেষ পর্যন্ত জার্মানি নিজেদের দুরবস্থার কথা বুঝতে পারে এবং সোচ্চার হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উড্রো উইলসনের ১৪ দফাকে সামনে রেখে এমন কিছু শর্ত এখানে চাপিয়ে দেয়া হয় যা ক্রমাগত জার্মানির দারিদ্র্য ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তোলে । এদিকে বিশ্বের নানা স্থানে থাকা জার্মান উপনিবেশগুলোও তাদের থেকে কেড়ে নেয়া হয়। এতে আর্থিক দিক থেকে ক্রমশ নাজুক অবস্থানে চলে যেতে থাকে তারা।
ফ্রান্সের নিরাপত্তানীতি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফ্রান্স তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অদ্ভুত কিছু দাবি উত্থাপন করে। আপাত দৃষ্টিতে পুরোপুরি অবাস্তব মনে হলেও শক্তিবলে মিত্রশক্তি এ দাবিগুলো জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেয়। এতে করে ফ্রান্সের নিরাপত্তা যতটুকু নিশ্চিত হোক আর নাই হোক অন্তত জার্মানি ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে সামরিক বাহিনী সংকোচনের পাশাপাশি নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী বিলুপ্তির দাবি জাতি হিসেবে জার্মানির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। এর জন্য তাদের মধ্যে একটি প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করেছে শুরু থেকেই। এদিক থেকে ধরলে ফ্রান্সের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের নামে জার্মানিকে শায়েস্তা করার যে পথ মিত্রবাহিনী অবলম্বন করে তা থেকেও যুদ্ধ অনেকটা আসন্ন হয়ে পড়েছিল ।
প্যারিস শান্তি সম্মেলন
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এর পরের বছর ১৯১৯ সালে বসানো হয় প্যারিস শান্তি সম্মেলন। নামের দিক থেকে একে প্যারিস শান্তি সম্মেলন বলা হলেও এতে আদৌ কোনো শান্তি আসেনি। উপরন্তু এতে নতুন অশান্তির বীজ উপ্ত হয়েছে ইউরোপে। এক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দেয়া হয় জার্মানির ওপর । আর তারা এজন্য দোষী সাব্যস্ত করে নানা দিক থেকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করে। একটি শান্তি প্রস্তাবনার কথা বলা হলেও সেখানে পরাজিত শক্তিকে উপস্থিতই থাকতে দেয়া হয়নি। এর থেকে তাদের মধ্যে প্রতিশোধপ্রবণতা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে রাইনল্যান্ডের কয়লাখনির ওপর ভাগ বসিয়ে মিত্রবাহিনী জ্বালানি শক্তি এবং অর্থনীতি দুদিক থেকেই জার্মানিকে পঙ্গু করে তোলার চেষ্টা চালায়।
জার্মানির প্রতিক্রিয়া
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে অনেকগুলো চুক্তির পাশাপাশি এমন কয়েকটি শর্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় যা জার্মানির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্যলিপিতে কালিমা লেপন করে। একের পর এক সরকার পরিবর্তন হলেও জার্মানির মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। এসময় বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আপসকামী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি পার্টি। নাৎসি নেতারা জার্মানির মানুষকে বুঝিয়ে বৈপ্লবিক অবস্থানে নিয়ে যায়। তারা পুরো জার্মানিকে বোঝাতে সক্ষম হয় তাদের সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য লেজ গুটিয়ে থেকে অপমানজনক শান্তির পথ বেছে নেয়ার চেয়ে সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। জনগণ তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শ্রদ্ধা দেখায়। নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসে হিটলার নেতৃত্বাধীন নাৎসি পার্টি। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এলেও অল্পদিনের মধ্যে পুরোপুরি স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোয় জার্মানির শাসনব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে কালবিলম্ব করেননি হিটলার। তার ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে সব ধরনের অন্যায় চুক্তির প্রতি জার্মানির বিরোধী অবস্থান লক্ষ করা যায়। নানা ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে হিটলার সরকারের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ আসন্ন করে তোলে ।
প্রতিযোগিতামূলক বাজার
ইউরোপের দেশগুলো বিশ্বের নানা স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করার পাশাপাশি বাণিজ্য বিস্তার শুরু করে। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির বিভিন্ন স্থানের খনিজ সম্পদের উপরেও ভাগ বসায় তারা। এতে করে ইউরোপে এক ধরনের অর্থনৈতিক অসাম্য তৈরি হয়। জার্মানি নিজেদের দেশে অবস্থিত খনি থেকে উত্তোলন করা জ্বালানি তাদের কাজে ব্যবহার করতে পারেনি। পক্ষান্তরে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এ থেকে সুবিধা নিয়ে অর্জিত শক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকে এদিকে সাখালিন দ্বীপের তেলের খনির দখল নিয়ে জাপানের সাথে সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণকে সে দফায় ঠেকিয়ে দিয়ে পূর্ব এশিয়ায় তাদের অগ্রগতি রোধ করতে সক্ষম হয় জাপান। এরপর ১৯৩১ সালের পর থেকে জাপান এশিয়ার একাধিপতি হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলতে প্রয়াসী হয়। ১৯৩৭ সালের দিকে বৃহত্তর এশিয়া বাণিজ্যিক অঞ্চল নিশ্চিত করতে মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে বসে জাপান। এসময় ঘটে যায় কুখ্যাত ‘নানকিং ম্যাসাকার' নামে গণহত্যার ঘটনা। এভাবে নানা সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আভাস লক্ষ করা যায়।
জাতিপুঞ্জের সমস্যা
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে লীগ অব নেশনস তথা জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নানা দিক থেকে সমস্যায় জর্জরিত ছিল। অর্থনীতি, রাষ্ট্র, রাজনীতি, নিরাপত্তা, কূটনৈতিক পরিসর কিংবা সমরনীতি সব দিক থেকেই অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে তোপ দাগার প্রবণতায় মনোযোগী ছিল এ সংগঠনটি। জার্মানি ও তার মিত্ররা এই নীতির অসারতা শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু প্রথমে তারা দুর্বল থাকায় সরাসরি এর বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। পরে ধীরে ধীরে তারা শক্তি সঞ্চয় করে বিরুদ্ধ অবস্থান নেয়। একের পর এক চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে জাতিপুঞ্জকে একটি পঙ্গু সংগঠন হিসেবে প্রমাণ করে তারা। ফলে অলীক শান্তির বাণী শুনিয়ে যে কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান মিত্রবাহিনী দাঁড় করিয়েছিল তা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে। এতে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ আসন্ন হয় যা বুঝতে কারো বাকি থাকেনি ।
ম্যাসন-ওভেরি বিতর্ক (The Flight into War)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে ম্যাসন ওভেরি বিতর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র। এক্ষেত্রে ১৯৮০ সালের দিকে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ রিচার্ড ওভেরি (Richard Overy) ও টিমোথি ম্যাসনের (Timothy Mason) মধ্যে যে তর্ক হয় সেখানে ১৯৩৯ সালে যুদ্ধ লাগার নানা কারণ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে ম্যাসন মনে করে একটি কাঠামোগত আর্থিক সংকটই হিটলারকে এই প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। তবে ওভ্যারি তার থিসিসে এ বিষয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি মনে করেন যদিও জার্মানিতে আর্থিক সংকট চলছিল তা পোল্যান্ডে আক্রমণ চালানোর মত ঘটনাকে সমর্থন দেয় না। এক্ষেত্রে ঘরে বাইরে একনায়কের দাপট প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টার জন্য তিনি জার্মানিতে গড়ে ওঠা নাৎসি স্বৈরতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন। সব মিলিয়ে তাঁদের গবেষণা ও বিতর্কিত অবস্থান থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কারণগুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে।
বেনিতো মুসোলিনি
উদারপন্থী শাসনের নামে পুরো ইতালিতে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ইতালির জন্য এমনি এক আপত্তিকর মুহূর্তে এগিয়ে আসেন বেনিতো মুসোলিনি। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করতে গিয়ে জীবনের ঘানি টানতে ব্যর্থ মুসোলিনি চলে যান সুইজারল্যান্ড। তারপর দেশে ফিরে তিনি গঠন করেন আধাসামরিক এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যার নাম ফ্যাসিস্ট পার্টি। এ বাহিনী তাদের নেতা মুসোলিনির বক্তব্যকেই নীতি ও আদর্শ হিসেবে মেনে প্রাচীন ইতালির সম্ভ্রম পুনরুদ্ধারে ব্যাপৃত হয় । অল্প সময়ের মধ্যেই মুসোলিনি একটি শক্তিশালী সামারিক দল গঠন করেন। ১৯২২ সালের দিকে হাজার হাজার ফ্যাসিস্ট স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে রাজধানী রোমের পথে রওনা হন মুসোলিনি। তখনকার রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলস বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেও তারা তার নির্দেশ মানেনি। এরপর ক্ষমতায় চলে আসেন ফ্যাসিস্ট পার্টির নেতা মুসোলিনি । প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসলেও সময়ের আবর্তে তিনি এক প্রভাবশালী স্বৈরশাসক বনে যান। তার নেতৃত্বেই ইতালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির স্বপক্ষে যুদ্ধ করে। প্রথম দিকে জার্মানি একের পর এক অঞ্চল দখল করে নিলেও তিনি নীরব থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সময়টাকে কাজে লাগিয়ে তিনি চেষ্টা করেন নতুন করে ইতালির সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানো যায় কি না সে বিষয়ে।
রাইনল্যান্ডে সেনা সমাবেশ
অপমানজনক ভার্সাই চুক্তিকে ঘোষণা দিয়ে অস্বীকার করে থার্ড রাইখ তথা হিটলার নেতৃত্বাধীন নাৎসি সরকার। ১৯৩৬ সালের মার্চের ৭ তারিখে রাইনল্যান্ডে সেনা সমাবেশ করে জার্মানি। এখানকার স্ট্রেসা ফ্রন্ট তার ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে ছিল । পশ্চিম জার্মানির ঠিক সে স্থানে জার্মান সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করে যা ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘনের শামিল। তখনকার ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দ্রুত এর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের তাঁর জীবনীতে লিখে গেছেন এখানে সেনা সমাবেশ শুধু ভার্সাই চুক্তির লঙ্ঘনই না, পাশাপাশি নতুন এক জার্মানির উত্থানবার্তা সবার কাছে জানান দেয়া।
ইতালির ইথিওপিয়া আক্রমণ
স্ট্রেসা সম্মেলন শেষ হলে ইতালি তার প্রভাববলয় বিস্তৃতির চেষ্টা চালায়। অ্যাংলো-জার্মান নেভাল এগ্রিমেন্ট ইতালির শাসক বেনিতো মুসোলিনিকে আফ্রিকা অভিমুখে তার সাম্রাজ্য বিস্তৃতির পথ দেখায়। এ পরিস্থিতিতে লীগ অব নেশনস ইতালিকে একটি আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে দেশটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বলে সবাইকে। ইতালি কোনো নিষেধাজ্ঞার ধার না ধেরে আক্রমণ পরিচালনা করে একের পর এক ভূখণ্ড দখল করতে থাকে। তারপর ৭ মে ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়া দখল করে তিনটি দেশ একত্রিত করে ইতালিয়ান ইস্ট আফ্রিকা নামে একটি উপনিবেশ পত্তন করে। এরপর ১৯৩৬ সালের ৩০ জুন সম্রাট হাইলে সেলাসি ইতালির কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করে লীগ অব নেশনসে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে মুসোলিনি লীগ অব নেশনস থেকে তার দেশের সদস্যপদ প্রত্যাহারের কথা সাফ জানিয়ে দিতে একটুও সময় নেননি। এর ফলে নতুন করে উত্তপ্ত হয় ইউরোপ ।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ
নন্দিত শিল্পী পাবলো পিকাসো তার বিখ্যাত জার্মেনিকা চিত্রকর্মটি অঙ্কন করেন ১৯৩৭ সালের দিকে। এখানে নাৎসি বাহিনীর নানা আক্রমণের দৃশ্য তুলির আঁচড়ে তুলে আনার একটি প্রচেষ্টা ছিল। তবে এ চিত্রকর্মটির থিম এতটাই বিচিত্র সেখান থেকে সারবস্তু খুঁজে বের করা বেশ কষ্টকর। স্পেনের দুটি পক্ষের দ্বন্দ্ব থেকে গৃহযুদ্ধের উপক্রম হলে জাতীয়তাবাদী সামরিক নেতা জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোকে অ্যাডলফ হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনির পক্ষ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়া হয়। অন্যদিকে স্প্যানিশ রিপাবলিকের পক্ষে লড়তে থাকা পক্ষকে সমর্থন দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৩৬ থেকে শুরু করে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এমনি নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে স্পেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ধীরে ধীরে স্পেনের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ইতালি-জার্মান পক্ষে বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। এ ঘটনাও তখনকার রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে প্রণোদিত করেছিল ।
দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ
আগ্রাসী জাপানি রাজতন্ত্র চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়ার শাসনকাজে একজন পুতুল শাসককে বসায়। এরপর ১৯৩৭ সালের দিকে মার্কোপলো সেতু দুর্ঘটনা নিয়ে দ্বিতীয় চীন জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। জাপান চীনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একের পর এক বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। ১৯৩৭ সালের ২২-২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাপান চীনের সাংহাই, নানকিং, গুয়াংঝাউ ও বেজিংয়ের নানাস্থানে বোমাবর্ষণ করে। এসময়েই জাপানের রাজকীয় বাহিনী (Imperial Japanese Army) নানকিংয়ের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছিলো। তারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যার পাশাপাশি তাদের লালসার শিকার হয় কয়েক লক্ষ নারী । এঘটনা এশিয়ার শান্তি বিনষ্ট করে।
আনস্কুলস ( Anschluss )
১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়ার বাহিনী জার্মানির একটি বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নেয় যাকে আনস্কুলস (Anschluss) নামে অভিহিত করা হয়। প্যান জার্মানিজম মতবাদ জার্মান জাতিসত্তার অন্তর্গত বিভিন্ন মানুষকে একই ভৌগোলিক পরিসরে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক মানচিত্রের অধীনে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখায়। এ উপলক্ষেই হিটলারের নাৎসি বাহিনী কাজ শুরু করে। তারা সবার আগে স্ট্রেসা ফ্রন্ট থেকে ১৯৩৫ এর দিকে যে অস্ট্রিয়া আত্মপ্রকাশ করে তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বসে। পাশাপাশি তাদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রোম-বার্লিন সমঝোতা বৃদ্ধি করে। পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হলে জার্মানি বাহিনী অগ্রসর হয়ে অস্ট্রিয়ার বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এরপর ধীরে ধীরে অস্ট্রিয়ার পক্ষের শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বাধ্য হলে জার্মান-ইতালি ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায়; যা আরেকটি যুদ্ধেরও প্রস্তুতিও বটে ।
মিউনিখ চুক্তি
চেক প্রজাতন্ত্রের সীমান্তঘেঁষে অবস্থিত সুডেটারল্যান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ জার্মান অঞ্চল। ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে মিত্রবাহিনী এ অঞ্চলকে জার্মানির থেকে কেড়ে নিয়ে নবগঠিত চেকোস্লোভাকিয়া তথা বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রকে দান করে। জার্মান নেতা হিটলার এটা মেনে নিতে না পেরে ১৯৩৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিনের সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হন। তিনি যেকোনো মূল্যে সুডেটার জার্মানির দখলে নেয়ার হুমকি দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তার পাশাপাশি চেকোস্লোভাকিয়ারও একটি শক্তিশালী সেনাদল ছিল। তারা এগুলো কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এ অবস্থায় ১৯৩৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করা হয় মিউনিখ চুক্তি। ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারেননি হিটলার কতবড় দাবি জানাতে পারেন। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার শান্তি নিশ্চিতকল্পে জার্মান বাহিনীর অবস্থান আরেকটি বিস্তৃত বিপদের ইঙ্গিত বয়ে আনে। ধীরে ধীরে এ মিউনিখ চুক্তিই জার্মান সমরবাদকে আরো আগ্রাসী করে তোলে ।
শ্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা
জার্মানি সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তারা ১৯৩৯ সালে মিউনিখ চুক্তি ভঙ্গ করে প্রাগ আক্রমণ করে। এসময় স্বাধীন শ্লোভাকিয়া রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে চেকোশ্লোভাকিয়ার বিলুপ্তি ঘটে। এক্ষেত্রে ওই অঞ্চল নিয়ে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের রাজনীতি করার আর কিছুই থাকেনি। ফলে ধীরে ধীরে তারাও যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়।
ইতালির আলবেনিয়া আক্রমণ
বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ইতালি একের পর এক বিশ্বের নানা দেশে আক্রমণ করতে থাকে। তাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী নীতির অংশ হিসেবে ১৯৩৯ সালের ২৫ মার্চ তিরানায় গিয়ে ইতালির বশ্যতা স্বীকার করার আহ্বান জানিয়ে ব্যর্থ হয় মুসোলিনি বাহিনী। তারপর ৭ এপ্রিল ১৯৩৯ আলবেনিয়া আক্রমণ করে ইতালির বাহিনী। মাত্র তিনদিনের লড়াইয়ে আলবেনিয়ার পতন ঘটে।
খালখিন গলের যুদ্ধ
রাশিয়া ও জাপানের সীমান্ত বিরোধ নিয়ে খালখিন গলের যুদ্ধ বাধে। এর আগে ১৯৩৮ সালে খাসান লেক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জাপান রাশিয়া একদফা লড়াই হয়েছিল। কিন্তু এবারের সীমান্ত বিরোধ নিয়ে যে লড়াই তা পূর্বের সব ধরনের যুদ্ধের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। জর্জ ঝুকভের নেতৃত্বাধীন রুশ বাহিনী এগিয়ে যায় জাপানিদের প্রতিরোধ করতে। এ যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলার পর ১৯৪৫ সালে সন্ধির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল এ যুদ্ধের।
ডানজিগ সংকট
চেকোশ্লোভাকিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অন্যরা বুঝে যায় এবারের থার্ড রাইখ জার্মানির ফুরার হিটলার কারো সাথে আপস করতে আসেনি। হিটলার যেকোনো মূল্যে জার্মান দখলদারিত্বকে আরো বিস্তৃত করতে চাইবেন সেটা বুঝতেও আর কারো দেরি ছিলো না। কিন্তু ততদিনের জার্মানি অনেক শক্তিমত্তা অর্জন করেছে। বলতে গেলে বিভিন্ন সেক্টরে সেই অজেয় জার্মান বাহিনীকে নতুন করে ফিরে পেয়েছেন ফুরার হিটলার। বাল্টিক অঞ্চলের দিকে ধীরে ধীরে থার্ড রেখ সরকারের দৃষ্টি আবদ্ধ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা দেয় ডানজিগ সংকট। মূলত ডানজিগ শহর মুক্ত করা নিয়ে যুদ্ধ বাধে এবার। ক্ষমতায় আসার পর নাৎসি সরকার পোল্যান্ডের সাথে যে বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছিল তা এ যুদ্ধে মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়।
মিত্রবাহিনীর সাথে পোল্যান্ডের সখ্য
ক্ষমতায় আরোহণের পর হিটলারের নাৎসি সরকার পোল্যান্ডের সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা জার্মানির শত্রুদের সাথে হাত মিলালে হিটলারের বাহিনী থেমে থাকেনি। ১৯৩৯ সালের মার্চে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা মিলিতভাবে পোল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। এক্ষেত্রে দেশটির ওপর হিটলার দাবি জানালে যুদ্ধ আসন্ন হয়ে যায় ।
রাশিয়ার পোল্যান্ড অভিযান
মলোটোভ-রিবেনট্রপ প্যাক্টের জন্য রাশিয়ার পোল্যান্ড অভিযান ইতিহাস বিখ্যাত। এক্ষেত্রে লড়াই বেশিদূর এগোনোর আগেই দুপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। এসময় স্বাক্ষর করা হয় বিখ্যাত একটি চুক্তি। ২৩ আগস্ট ১৯৩৯, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভায়েশ্লেভ মলোটোভ (Vyacheslav Molotov) এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ফন রিবেনট্রপ (Joachim von Ribbentrop)-এর মধ্যে সম্পাদিত এ চুক্তিতে নির্ধারণ করা হয় আপাতত রাশিয়া কিংবা জার্মানি কেউ কারো ওপর আক্রমণ করবে না। অন্যদিকে সেনা সমাবেশ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক তৎপরতা বেড়ে যায় বিশেষ কারণে। আর এই তিক্ততা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় বিশ্বযুদ্ধে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions