মুদ্রাস্ফীতির ফলাফল
মুদ্রাস্ফীতির আর্থ-সামাজিক ফলাফল বা মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব :
মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সমাজের উৎপাদন, কর্মসংস্থান, মূল্যস্তর এবং আয় বন্টনের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হলঃ
(ক) উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতি বিশেষ করে মৃদু মুদ্রাস্ফীতি দেশের উৎপাদন ও নিয়োগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মূল্যস্তর মৃদুভাবে বাড়তে থাকলে মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দেয়। কারণ, ব্যবসায়ী ও উৎপাদকগণ যে দামে কাচামাল ক্রয় করে দ্রব্য উৎপাদন করে তার তুলনায় উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রয় করে বেশি দাম পেয়ে থাকে। ফলে তারা অধিক মুনাফা লাভ করে। মুনাফার পরিমান বেড়ে গেলে তারা উৎপাদনের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে দেশের মোট উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এজন্য অনেকে মনে করেন যে, মৃদু মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাম্য। অবশ্য উৎপাদন, কর্মনিয়োগ, জাতীয় আয় প্রভৃতির উপর মুদ্রাস্ফীতির এ শুভ প্রতিক্রিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় যতক্ষণ দেশ পূর্ণ নিয়োগস্তরে না পৌছে। কিন্তু পূর্ণ নিয়োগস্তর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যদি মুদ্রাস্ফীতি ঘটে তাহলে মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন ও কর্মনিয়োগ সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয় না। ফলে মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করে এবং দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ সময় ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারিগণ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিবর্তে ফটকা কারবারের দ্বারা দ্রুত মুনাফা অর্জন করতে আগ্রহী হয়। ফলে দেশের প্রকৃত উৎপাদন কমে যায়। তাছাড়া অর্থের ক্রয়শক্তি দ্রুত কমতে থাকে, বলে সঞ্চয়কারী সঞ্চয়ের পরিবর্তে ভোগ ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ফলে মূলধন গঠন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। চরম মুদ্রাস্ফীতির সময় উদ্যোক্তাগণও উৎপাদন ক্ষেত্রে ঝুঁকি গ্রহণ করতে আগ্রহী হয় না। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির ফলে শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ও নিয়োগ কমে আসে।
(খ) আয় বণ্টনের উপর প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতির ফলে অর্থ ও সম্পদ এক শ্রেণীর লোকের হাত হতে অন্য এক শ্রেণীর লোকের হাতে চলে যায়। ফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোক বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়।
১। মুদ্রাস্ফীতির সময় নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দরূন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং তারা আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় নির্দিষ্ট আয়ের ব্যক্তিরা তাদের আয় দ্বারা পূর্বাপেক্ষা কম দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পায়। ২। মুদ্রাস্ফীতির ফলে শ্রমিক শ্রেণীও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বাড়তে পারে; কিন্তু মূল্যস্তর যে হারে বাড়ে মজুরি তা অপেক্ষা কম হারে বাড়ে। ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং জীবনযাত্রার মান হ্রাস পায় ।
৩। মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেনাদাররা লাভবান হয়; কিন্তু পাওনাদারেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় দেনাদার বা ঋণগ্রহিতারা অপেক্ষাকৃত কম দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করে নির্দিষ্ট পরিমাণ দেনার অর্থ পরিশোধ করতে পারে। অপরপক্ষে, মুদ্রাস্ফীতির সময় ঋণ দাতা বা পাওনাদারেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারণ, তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ফিরে পেলেও তা দ্বারা পূর্বাপেক্ষা কম পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারবে।
৪। মুদ্রস্ফীতির ফলে কৃষিজীবিগণ লাভবান হয়। মুল্যস্তর বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় খুব একটা বাড়ে না, অথচ কৃষিজাত দ্রব্যের মূল্য বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কৃষিজীবিগণ লাভবান হয়, তবে ভূমিহীন খেতমজুরেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৫। মুদ্রাস্ফীতির ফলে করদাতাগণের সুবিধা হয়। কারণ, করদাতাগণ পূর্বাপেক্ষা কম দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকারি ঋণের প্রকৃত ভার কমে যায়। কারণ, নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারকে পূর্বাপেক্ষা কম পরিমাণ প্রকৃত সম্পদ ব্যয় করতে হয়। তবে কর গ্রহণের দিক হতে সরকার মুদ্রাস্ফীতির সময় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারণ, সরকার কর হতে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক আয় পায় তার প্রকৃত মূল্য মুদ্রাস্ফীতির সময় কমে যায়।
৬। যে সমস্ত নিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয়ে অর্থ বিনিয়োগ করে তারা মুদ্রাস্ফীতির সময় লাভবান হয়। তবে যে সমস্ত বিনিয়োগকারীরা নির্দিষ্ট সুদ লাভের জন্য বণ্ড বা ডিবেঞ্চারে অর্থ বিনিয়োগ করে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
(গ) মূল্যস্তরের উপর প্রভাব :
মুদ্রাস্ফীতির ফলে সাধারণ মূল্যস্তর এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। মুদ্রাস্ফীতির সময় অর্থের যোগান বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজের ব্যয়োপযোগী আয়ের পরিমাণ বেড়ে মোট চাহিদা বৃদ্ধি পায়। দেশে পূর্ণ নিয়োগ অবস্থার পূর্ব পর্যন্ত চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়। ফলে দাম স্তর বাড়তে পারে না; কিন্তু দেশ পূর্ণ নিয়োগ অবস্থায় পৌছানোর পর দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয় না। চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় জিনিসপত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি না পাওয়ায় দ্রব্য মূল্যের বৃদ্ধি ঘটে। তাই মুদ্রাস্ফীতি যদি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় তাহলে শ্রমিকরা অধিক মজুরি দাবি করে। মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পায় এবং সে সাথে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পায়। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দ্রব্যমূল্য আরও বেড়ে যায়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেশে উৎপাদন ব্যয় এবং মুল্যস্তর বৃদ্ধি পায় ।
(ঘ) সামাজিক প্রভাব:
মুদ্রাস্ফীতির সামাজিক প্রভাবও শুভ নয়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে যে সাধারণ দামস্তর বৃদ্ধি পায় তাতে সমাজে ধনী শ্রেণী অপেক্ষা দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় ধনীরা আরও ধনী হয় এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির সময় সমাজের আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ফলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির জন্য দাবি করে । এর ফলে অনেক সময় শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট এবং অন্যান্য রকমের শ্রমিক-মালিক বিরোধ এবং সামাজিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতির সময় এক শ্রেণীর লোক অধিক মুনাফা লাভের আশায় চোরাচালান, দ্রব্যের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি, কালোবাজারি প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটে ।
সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির দেশের অর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয় ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions