ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল
ভারতবর্ষে প্রায় দু'শ বছরের ব্রিটিশ শাসন ছিল খুবই ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ শাসনের অভিঘাতে বাংলা তথা ভারতবর্ষের চিরায়ত প্রায় স্বনির্ভর ও স্বনিয়ন্ত্রিত গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙ্গে পড়েছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এসেছিল আমূল পরিবর্তন। নিম্নে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল আলোচনা করা হল-
সামাজিক ব্যবস্থা
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় সমাজ কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। উপনিবেশিক শাসনের পরিনতিতে বাংলা তথা ভারতবর্ষের নাগরিকরা নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা বেশি শোচনীয় হয়ে পড়ে বলে অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকে মুসলমানরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।
ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত, বিধবা বিবাহ চালু, বাল্য বিবাহ রোধ, আলীগড় আন্দোলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তন আসে বর্ণ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সামাজিক স্তর বিন্যাসে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ইংরেজি শিক্ষা, পুঁজিবাদের প্রসার ও নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে বাংলার সামাজিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অনেকে দাবী করেন যে, ব্রিটিশরাই ঔপনিবেশিক শাসন প্রলম্বিত করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বপন করে। এ বিভেদ নীতির কারণে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। ব্রিটিশদের রোপিত সাম্প্রদায়িকতার বীজ পরবর্তীতে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয় যার ফলস্বরূপ শুধু বাংলা প্রদেশের বিভক্তি হয়নি, বিভক্ত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশও।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণ নিজেদের শাসন ও শোষণের অনুকূলে এক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব করেন। এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদ লুণ্ঠন ও রাজস্ব সংগ্রহ। ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমি বন্দোবস্ত প্রথা, চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, ভূমির মালিকানা স্বত্ব প্রদান, কর আরোপ ও আদায়ের নতুন-নতুন রীতি-নীতি বাংলার অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা নতুন জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির জন্ম দেয়। ব্রিটিশ শাসকদের পাশাপাশি দু'শ্রেণির শোষণ ও নিপীড়ন বাংলার কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। জোরপূর্বক চালুকৃত নীল চাষ একদিকে যেমন জমির উৎপাদন হ্রাস করে, তেমনি কৃষকদেরকে স্বোপার্জিত অর্থনীতি থেকে উৎখাত করে।
ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে বাংলার স্থানীয় শিল্প-কারখানা, কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। ব্রিটিশ শাসকরা বাংলাকে শিল্পের কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহার করে। আবার বাংলার কাঁচামাল থেকে তৈরী জিনিসের বাজার হিসেবে ব্যবহার করে এই ভারতবর্ষকেই। ব্রিটিশ প্রবর্তিত অর্থনীতিতে বাংলায় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে, আর এই পুঁজিপতি শ্রেণিই বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা
ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতবর্ষে সমাজ-সংস্কৃতি, জীবন-ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রভৃতি জায়গায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে, যার ছোঁয়া লাগে রাজনৈতিক অঙ্গনেও। ঔপনিবেশিক শাসনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভূতপূর্ব প্রসার। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এক পর্যায় এসে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক অধিকার, স্বাধিকার, জাতীয়তাবাদ এ সমস্ত তত্ত্বের সাথে পরিচিতি লাভ করে। এর ফলে প্রথমে দাবি ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদারিত্বের, পরবর্তীতে তা ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করে স্বশাসনের দাবিতে পরিণত হয়।
ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম লাভ করে প্রথম রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস'। ১৯০৬ সালে জন্ম লাভ করে ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ'। এ দু'টি রাজনৈতিক দল ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাস্তবিক রূপ দেয় ।
ব্রিটিশ শাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ১৮৬১ সাল থেকে শুরু করে গৃহিত বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক সংস্কার। যার মাধ্যমে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য ধারার সংসদীয় শাসনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions