ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব
ভাষা আন্দোলন:
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলার জনগণের স্বাধিকার আদায়ের পদক্ষেপের সূচনা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। প্রথমে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। তারা বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চায়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার পল্টন ময়দানে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা” । এ ঘোষনার পর পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য তারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন পূর্ব বাংলার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দিন জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। ফলে ছাত্র-সমাজ তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহবান ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। পুলিশ ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, সফিউর, জব্বারসহ কয়েকজন শহীদ হন। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব বাংলা। শুরু হয় মাতৃভাষার অধিকার আদায় ও বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। অবশেষে বাঙালি জাতি বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে। ভাষা আন্দোলন বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও এর রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল স্থান দখল করে আছে। জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব
১. স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ : ভাষা আন্দোলন সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনা বাঙালি জনগণকে এ ধারণা প্রদান করে যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বসবাস করলেও তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র সত্তা, স্বতন্ত্র স্বার্থ এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্ব।
২. বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ : ভাষা আন্দোলন জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে ধর্মের মিল ছাড়া বাঙালীদের যে আর কোন বন্ধন নেই, তা তারা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে। ১৯৫২ সালে আত্মাহুতির মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হয়, চেতনার পথ ধরে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে ২১ দফার জয় হয়, বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়।
৩. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি : বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয় সংহতি ও একাত্মবোধ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. পরবর্তী আন্দোলনে প্রভাব : ১৯৫২ পরবর্তী পূর্ব বাংলার সকল রাজনৈতিক আন্দোলন ভাষা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানসহ বাঙালির প্রত্যেকটি আন্দোলনের ভিত্তিমূল হচ্ছে ভাষা আন্দোলন।
৫. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেরণা: ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে । তাদের মধ্যে নায্য দাবী উত্থানে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদের বোধ জাগিয়ে তোলে ।
৬. ছাত্র-সমাজের গুরুত্ব: এ আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। পরবর্তীতে ছাত্ররাই রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয় ।
একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিন ১৮৮টি দেশ ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions