মাস্টারদা সূর্যসেন
ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের মধ্যে মাস্টারদা সূর্যসেনের নাম অগ্রগণ্য। সূর্যসেন পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক। তাই তাঁকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য বলা হত মাস্টারদা সূর্যসেন। ছাত্রজীবন থেকেই ভারতবর্ষের গরীব-দুঃখী মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁকে ব্যাথিত করে তোলে । রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতা হিসেবে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাতে তাঁর চিত্ত শান্ত হয় নি। ভারতবর্ষের শোষিত মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়ন দ্রুত বন্ধের জন্য তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি বেছে নেন। সূর্যসেন মনে করতেন বিপ্লব ছাড়া ব্রিটিশদের ভারতবর্ষ থেকে সরানোর স্বপ্ন সুদূর পরাহত। সূর্যসেন তাঁর নেতৃত্বের গুণে অনেক তরুণ-তরুণীদের সংগঠিত করতে পেরেছিলেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামী বাহিনীর সদস্য করতে পেরেছিলেন। এই সশস্ত্র সংগ্রামীদের সাথে নিয়েই ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষ্যে মাস্টারদা ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৩৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সূর্যসেনকে ফাঁসি দেয়া হয়।
মাস্টারদা সূর্যসেনের জীবন বৃত্তান্ত
মাস্টারদা সূর্যসেন ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী। সূর্যসেনের বাবা পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক। সূর্যসেন স্থানীয় দয়াময়ী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন।
সূর্যসেন যখন নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) কেন্দ্র করে বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমে এই আন্দোলন বিশেষ করে চট্টগ্রাম এলাকায় বিপ্লবী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯১৬ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ. শ্রেণিতে পড়াকালীন শিক্ষক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তী কর্তৃক বৈপ্লবিক আদর্শে দীক্ষিত হন। সূর্যসেন। সূর্যসেন চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী একটি বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন ।
মাস্টারদা সূর্যসেনের রাজনৈতিক চিন্তা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড
সূর্যসেনের শিক্ষক অধ্যাপক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তী যুগান্তর নামক বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন ও যুগান্তর এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। ১৯১৮ সালে বহরমপুর থেকে ফিরে এসে সূর্যসেন ‘যুগান্তর' দলে যোগ দিয়ে সংগঠনটিকে সক্রিয় করে তোলেন এবং বিবাদমান দল দুইটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ক্রমে তাঁর দলই চট্টগ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের ছাত্ররা ক্লাস বর্জনসহ সভা-সমাবেশ করে। সভায় সূর্যসেন তাঁর বক্তৃতায় ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে তিনি স্কুলের শিক্ষকতা ত্যাগ করেন এবং দেওয়ানবাজার এলাকায় ‘সাম্যশ্রম’ নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ‘সাম্যশ্রম' থেকেই কংগ্রেসের কাজ ও গোপনে বিপ্লবীদের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন সূর্যসেন। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন দ্বারা স্বরাজ অর্জন ব্যর্থ হলেও পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে সংকল্পবদ্ধ হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন মাস্টারদা। এক পর্যায়ে সূর্যসেন গ্রেফতার হন এবং ১৯২৮ সালের শেষ দিকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। চট্টগ্রামে তিনি 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, এর একটি শাখা গড়ে তোলেন।
১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সূর্যসেন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। এ সময়ে বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিল ও বিপ্লবী কার্যক্রমের পরিকল্পনাও নির্দেশনা দিতে থাকেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিলের সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং অস্ত্রাগার লুটের ঘটনা ছিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফসল । ১৯৩২ সালের জুন মাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তকে চট্টগ্রাম কারাগার ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরে ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রীতিলতা পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান। এ সময় প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনার পর মাস্টারদা পটিয়া এলাকার গৈরালা গ্রামে আত্নগোপন করেন। একজন গ্রামবাসীর বিশ্বাসঘাতকতায় ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা গ্রেফতার হন। পরের বছর ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions